মে ১০, ২০২৫

শনিবার ১০ মে, ২০২৫

কুমিল্লায় কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির বাসা

Rising Cumilla - Babui bird
বানাশুয়া রেলসেতুর কাছের কিছু তালগাছে দেখা গেছে বাবুই পাখির বাসা/ছবি: রাইজিং কুমিল্লা

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার এক সময়ের পরিচিত দৃশ্য—উঁচু তালগাছ কিংবা নারিকেল গাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা—আজকাল যেন রূপকথার গল্প। উপজেলার আনাচে-কানাচে আগে যেমন অজস্র বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত, এখন তা প্রায় বিরল।

পরিবেশ বিপর্যয় আর কালের পরিবর্তনে এই পাখি ও তাদের নিপুণ হাতের তৈরি বাসা বিলুপ্তির পথে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এক অসাধারণ স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর।

খড়, নারকেল ও তালগাছের কচি পাতা, ঝাউ এবং কাশবনের লতাপাতা দিয়ে বাবুই পাখি তাদের চমৎকার বাসা তৈরি করত। এই বাসা শুধু দেখতেই আকর্ষণীয় ছিল না, বরং ছিল অবিশ্বাস্যরকম মজবুত। ঝড়-বৃষ্টিতেও তাদের নিপুণ নির্মাণশৈলী অক্ষুণ্ণ থাকত। বাবুই পাখির বাসার শক্ত বুনন এতটাই মজবুত হতো যে, টেনে ছিঁড়াও ছিল বেশ কঠিন কাজ।

বাসা তৈরির পর পুরুষ বাবুই সঙ্গী খুঁজে বের হতো অন্য বাসায়। পছন্দের সঙ্গী পেলে তাকে আকৃষ্ট করার জন্য চলত নানা কসরত। খাল, বিল ও ডোবায় নেচে নেচে গাছের ডালে নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলত তারা। অর্ধেক বাসা তৈরি হওয়ার পর পুরুষ বাবুই তার কাঙ্ক্ষিত সঙ্গীকে সেই বাসা দেখাত। বাসা পছন্দ হলেই কেবল গড়ে উঠত তাদের নতুন সংসার। স্ত্রী বাবুইয়ের মন জয় করতে পারলে বাকি চার দিনে পুরুষ বাবুই শেষ করত তার শিল্পকর্ম। ধান ঘরে তোলার মৌসুম ছিল বাবুই পাখির প্রজননকাল। মা বাবুই দুধ ধান সংগ্রহ করে বাচ্চাদের খাওয়াত। সাধারণত উঁচু গাছই তাদের পছন্দের স্থান ছিল বাসা বাঁধার জন্য। তবে পরিবেশের পরিবর্তনে তারা এখন ভিন্ন গাছেও বাসা বাঁধতে বাধ্য হচ্ছে।

একসময় আদর্শ সদর উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে শত শত বাবুই পাখির বাসা দেখা গেলেও, বর্তমানে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। এখন কালেভদ্রে দু-একটি বাসা চোখে পড়ে। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে বানাশুয়া রেল সেতুর কাছের কিছু তালগাছ, যেখানে এখনও কিছু বাবুই পাখির বাসা দেখা গেছে।

পাখি ভালোবাসেন এমন একজন স্থানীয় বাসিন্দা অর্ণব রাইজিং কুমিল্লাকে জানান, “ছোটবেলায় অনেক পাখি পুষেছি, বাবুই পাখিও ছিল তাদের মধ্যে। একদিন ঝড়ের সময় দুটো বাবুই ছানা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তখন আমি তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তাম। এখন আর তেমন দেখা যায় না। আগে আমাদের নারকেল গাছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা ছিল। সারাদিন পথে আসা যাওয়ার সময় সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কী সুন্দর দেখতে!”

আরেকজন পাখিপ্রেমী আব্দুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে রাইজিং কুমিল্লাকে বলেন, “আগে আমাদের বাড়ির আশেপাশে প্রচুর সুপারি গাছ ছিল। প্রায় প্রতিটা গাছেই পাঁচ-ছয়টা করে বাবুই পাখির বাসা থাকত। এখন গাছ তো আছে, কিন্তু বাবুই পাখি নেই, তাই বাসাও নেই।”

জানা গেছে, এক শ্রেণির অসাধু মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে শহরের বিত্তশালীদের কাছে বিক্রি করছে। এই দৃষ্টিনন্দন বাসাগুলো এখন শোভা পাচ্ছে তাদের ড্রইং রুমে। বাবুই পাখির অসাধারণ শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়ে কবি রজনীকান্ত সেন লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা—’বাবুই পাখি ডাকি, বলছে চড়াই কুঁড়ের ঘরে থেকে করিস শিল্পের বড়াই/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে তুমি কষ্টপাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।’

পাখিপ্রেমী মানুষেরা মনে করেন, বাবুই পাখি ও তাদের বাসা সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট জীব ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন