
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটোরিয়ামের সেমিনার হলে সম্প্রতি (৫ মে ২০২৫) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল “বাংলাদেশ ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা সমিতি – Bangladesh History and Archaeology Research Society (BHARS)” এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজ এর শিক্ষার্থী ও অনুসারীদের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি দেশের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় এক নতুন মাইলফলক হয়ে উঠেছে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল সমিতির গঠনের পেছনের প্রেক্ষাপট এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে একটি পরিচিতিমূলক উপস্থাপনা। আয়োজকরা জানান, “এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গঠনমূলক গবেষণা, তথ্যনির্ভর ও সংরক্ষণমূলক কাজ পরিচালনা এবং ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব কে গণমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।”
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজ। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্ধারণের ভিত্তি। এ বিষয়ে গবেষণা কেবল শিক্ষার চর্চাই নয়, এটি একটি জাতির মনন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেরও নির্দেশক।”
তিনি আরো বলেন, “এই সংগঠনের যাত্রা একটি স্বপ্নের বাস্তব রূপ। যারা এই সংগঠন গড়ে তুলেছেন, তারা শুধু আমার ছাত্র-ছাত্রী নন, তারা এই দেশের অতীতকে জানার দায়বদ্ধতা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার পথিক।”
এই বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “ইতিহাস গবেষণা যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র, যা তারা যুদ্ধ করে অর্জন করেছে।
এই জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস এখনো অনেকাংশে অনুদ্ঘাটিত। এমতাবস্থায়, ইতিহাস গবেষণার জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জরুরত রয়েছে।”
Bangladesh History and Archaeology Research Society – BHARS এর অন্যতম সদস্য ড. মাহবুবুল হাসান বলেন, “ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের মেলবন্ধনে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এই গবেষণা সংগঠন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক ও পাঠক সবার জন্য উপযোগী ও উন্মুক্ত থাকবে।
আমি সংগঠনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজ স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আমাদের সকল গবেষককে একত্রিত হয়ে এরকম একটি সংগঠন পরিচালনার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।”
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ইতিহাস একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, কলা ও মানবিকী অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মালিহা নার্গিস আহমেদ, ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. এমরান জাহান, স্থপতি ড. সাজিদ বিন দোজা, BHARS এর প্রকাশনা সহযোগী নুর-ই-মোনতাকিম আলমগীর প্রতীক, সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ, গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে, “এই সংগঠন শুধু একাডেমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং মাঠ পর্যায়ে গবেষণা, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ, জনগণের অংশগ্রহণে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চা এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা সমিতি’র ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা পেশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, “সংগঠনটি শীঘ্রই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলসমূহে গবেষণা ও নথিভুক্তকরণের কাজ শুরু করবে। এছাড়া নিয়মিতভাবে সেমিনার, ওয়ার্কশপ সহ বিভিন্ন গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনা চালু করা হবে।”
অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল, সংগঠনের ফেলো ও সদস্যদের রচিত গবেষণামূলক বিভিন্ন গ্রন্থের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি উপস্থিত দর্শকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহের সৃষ্টি করে। অনেকে সেখানে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং ইতিহাসপ্রেমী নতুন প্রজন্মের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের শেষাংশে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা বলেন, তারা চান এই সংগঠন একদিকে যেমন গবেষণাকে আরো আধুনিক ও তথ্যনির্ভর করবে, অন্যদিকে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চাকে শুধু পাঠ্যবইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের প্রতিটি স্তরে নিয়ে যাবে। তাঁরা জানান, সংগঠনটির দরজা সকল আগ্রহী গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এই আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুধু একটি নতুন সংগঠনের সূচনা নয়, এটি দেশের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় ও গবেষণায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। অধ্যাপক ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজের নেতৃত্বে এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে গঠিত এই সংগঠন ভবিষ্যতে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার একটি প্রভাবশালী কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, এমন আশাই করছেন সংশ্লিষ্টরা।