এপ্রিল ১, ২০২৫

মঙ্গলবার ১ এপ্রিল, ২০২৫

সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ঈদ: মানবতার নতুন দৃষ্টান্ত

Rising Cumilla - Mother And Child
ছবি: রাইজিং কুমিল্লা/শাদমান আল আরবী

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন দিনের সূচনা। বছর ঘুরে প্রতিটি দিন অপেক্ষার প্রহর গুনে আসে কাঙ্খিত এই দিন, যখন মানুষ ভুলে যায় ক্লান্তি, ভুলে যায় দুঃখ-কষ্ট এবং হতাশার বেড়াজাল। চারপাশ রঙিন হয়ে ওঠে নতুন পোশাকের মেলায়, সুস্বাদু খাবারের আয়োজন আর প্রিয়জনের হাসিতে।  তবে, সকলের ঈদ কি একরকম? ঈদের রঙ কি ছড়িয়ে পড়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর নতুন জামায়? কিংবা পথের ধারে বসে থাকা বৃদ্ধ ভিখারির ঝুলিতে? সমাজের উঁচু তলার রঙিন ঈদ উৎসবের বাইরে রয়েছে এমন এক বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত।

তাদের জন্য ঈদ যেন কেবল আরও একটি সাধারণ দিন। সেই দিনেও পেটে ক্ষুধা, গায়ে মলিন জামা, চোখে হতাশার ছাপ নিয়ে কাটাতে হয়। অথচ, ঈদের আসল শিক্ষা তো এখানেই—সাম্যতা, সহমর্মিতা, আর মানবতার মহান সেতু গড়ে তোলা। ঈদ মানে শুধু নিজের আনন্দ নয়; ঈদ মানে সবার মুখে হাসি ফোটানো, উঁচু নিচু সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হতে পারে—সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ঈদ।

ঈদুল-ফিতরের মূল বার্তা হলো ত্যাগ, সংযম, আর দানশীলতা। পুরো রমজান মাস জুড়ে মানুষ সংযমের অনুশীলন করে। ক্ষুধা ও পিপাসার কষ্টকে হৃদয়ে ধারণ করে বোঝার চেষ্টা করে দরিদ্র মানুষের জীবনের কঠিন বাস্তবতা। আর এই উপলব্ধির পরেই আসে ঈদ, যখন জাকাত আর সদকার মাধ্যমে সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু এই দায়িত্ব কি আমরা ঠিকভাবে পালন করছি?

ঈদ তো কেবল ভোগ-বিলাসের উৎসব নয়। ঈদ আমাদের শেখায় সাম্য, সংযম, আর ত্যাগের শিক্ষা। ঈদুল-ফিতরের আরেক নাম ‘ভাগাভাগির ঈদ’, যে উৎসব কেবল নিজের জন্য নয়, বরং চারপাশের প্রতিটি মানুষের জন্য।

আজকের সমাজে ঈদ যেন অনেক ক্ষেত্রেই ভোগ-বিলাসের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। দামি পোশাক, দামি খাবার, আর বিলাসবহুল আয়োজনের মধ্যেই আটকে গেছে ঈদের উৎসব। অথচ একটু ফিরে তাকালেই দেখা যায়, আমাদের চারপাশেই রয়েছে অসংখ্য অসহায় মানুষ, যারা এক টুকরো হাসির আশায় দিন গুনছে।

যেদিন সমাজের অনেক শিশু নতুন জামায় সেজে ঈদের নামাজে যায়, অন্যদিকে পথের ধারে থাকা সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা সেই দৃশ্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তাদের কাছে ঈদ মানে না নতুন জামা, না সুস্বাদু সেমাই। তাদের কাছে ঈদ মানে শুধুই বেঁচে থাকার প্রতিদিনের সংগ্রামের আরেকটি দিন। মলিন কাপড়ে ঈদ কাটানো এই শিশুদের জন্য ঈদ যেন আনন্দ নয়, বরং একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। যখন পাশের বাড়ির সমবয়সীরা নতুন খেলনা পায়, তখন তারাও হয়তো সেই আনন্দে সামিল হতে চায়। কিন্তু অভাবের বেড়াজাল তাদের সেই স্বপ্নগুলোকে প্রতিনিয়ত ভেঙে যায়।

ঈদের আসল সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে ভালোবাসা আর ভাগাভাগির মধ্যে। যেদিন একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু নতুন জামা পেয়ে হাসবে, যেদিন কোনো অভাবী মা তার সন্তানকে ঈদের দিনে পেট ভরে খাবার খাওয়াতে পারবে—সেদিনই প্রকৃত অর্থে ঈদ পূর্ণতা পাবে। তাই ঈদের আনন্দকে শুধুমাত্র নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তা ছড়িয়ে দিতে হবে চারপাশের সেই মানুষদের মাঝে, যারা হয়তো বছরের পর বছর ঈদের দিনেও কেবল বঞ্চনার কষ্টই ভোগ করে আসছেন।

ঈদের আনন্দ প্রকৃতপক্ষে পূর্ণতা পায় তখনই, যখন আমরা তা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে উপভোগ করি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা নিজেদের মধ্যে উপহার বিনিময় করো, কারণ এটি পরস্পরের ভালোবাসা বৃদ্ধি করে।” এই বার্তা আমাদের ঈদের শিক্ষা দেয়—ভালোবাসা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে একে অপরের প্রতি একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার।

লেখক/গ্রাফিক্স: রাইজিং কুমিল্লা

সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করা খুব বড় কাজ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে, এটি খুব ছোট ছোট উদ্যোগ দিয়েই সম্ভব। হয়তো আপনার একটি পুরোনো জামা কিংবা সামান্য অর্থ একজন পথশিশুর ঈদকে স্মরণীয় করে তুলতে পারে। হয়তো কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি কমিউনিটি প্রজেক্ট কিংবা সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে কয়েক ডজন পরিবারের জন্য ঈদে খাদ্য সহায়তা নিয়ে আসতে পারে। সম্প্রতি আমাদের আশেপাশে অনেক সংগঠন এবং ব্যক্তি এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। কেউ গরিবদের মধ্যে ইফতার বিতরণ করছেন, কেউবা পথশিশুদের নতুন জামা দিচ্ছেন। এমন উদ্যোগগুলো আমাদের সমাজে আশার আলো জ্বালায়। এটি প্রমাণ করে, মানবতার চর্চা এখনো হারিয়ে যায়নি।

তাই যদি ঈদের নতুন জামা কিনতে গিয়ে আমরা একটু কম খরচ করি, কিংবা ঈদের দিনের খাবার থেকে কিছুটা কম বিলাসিতা করে সেই টাকা দিয়ে একাধিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সাহায্য করি, তাহলে আমাদের ঈদ হবে আরও অর্থবহ, আরও আনন্দময়।

যখন একটি শিশুর হাতে ঈদের দিন চকলেট, খেলনা, কিংবা একটি নতুন জামা তুলে দেওয়া হয়, তখন তার মুখের সেই উজ্জ্বল হাসি কেবল একটি মুহূর্তের আনন্দ নয়—এটি আমাদের মানবতার জয়ের অনন্য উদাহরণ। এই হাসি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবী তখনই সুন্দর হবে, যখন আমরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হব।

একবার এক ধনী ব্যক্তি ঈদের আগে বাজার থেকে দামি পোশাক কিনে ফিরছিলেন। পথে তিনি দেখলেন, এক ছোট্ট পথশিশু মলিন কাপড়ে দাঁড়িয়ে সেই পোশাকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ধনী ব্যক্তি একটু এগিয়ে গিয়ে তার কাছে জানতে চাইলেন, “তোমার ঈদের জামা কি হয়েছে?” শিশুটি মৃদু হেসে বলল, “না চাচা, ঈদের জামা আমার কখনো হয় না।” ধনী ব্যক্তি এক মুহূর্তে নিজের সন্তানের জন্য কেনা দামি জামার প্যাকেটটি শিশুটির হাতে দিয়ে বললেন, “এই নাও, এবার ঈদে এটা পরো।” শিশুটি অবিশ্বাস আর আনন্দে চমকে উঠে বলল, “আমার জন্য! সত্যি?” ধনী ব্যক্তির চোখে তখন তৃপ্তির পানি এসে গিয়েছিল। তিনি অনুভব করলেন, তার ঈদ এবারই পূর্ণতা পেল। এই ছোট্ট গল্প আমাদের শেখায় যে, একটি সামান্য দানও কতটা বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য প্রয়োজন শুধু অর্থের নয়, মানবিকতারও। হয়তো আপনার কাছে অতিরিক্ত অর্থ নেই, কিন্তু আপনার সময়, ভালোবাসা, আর সহানুভূতি দিয়ে আপনি একজন দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। ঈদের দিনে পথশিশুদের নিয়ে কিছুক্ষণ খেলায় মেতে উঠলেও তাদের মুখে হাসি ফুটবে।
ঈদের দিন আমাদের ঘরে যে অতিরিক্ত খাবার তৈরি হয়, তা যদি আমরা পাশের দরিদ্র প্রতিবেশীর সাথে ভাগাভাগি করি, তাহলে সেও ঈদের আনন্দে সামিল হতে পারবে। এসব ছোট ছোট কাজগুলোই একটি বড় মানবিক পরিবর্তনের সূচনা করে।

আমাদের স্বপ্ন হতে পারে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে ঈদের দিনে কেউ অভুক্ত থাকবে না, কেউ নতুন জামার জন্য হতাশ হবে না। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আর ত্যাগের চর্চা।

ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ এই উৎসবে সামিল হতে পারে। তাই আসুন, এই ঈদে আমরা সবাই মিলে একটি মানবিক দৃষ্টান্ত গড়ে তুলি। আসুন, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ঈদকে আনন্দময় করি।
আমাদের হৃদয়ের উষ্ণতায় ফুটে উঠুক নতুন দিনের সূচনা। ঈদ হোক সবার জন্য, ঈদ হোক মানবতার এক নতুন দৃষ্টান্ত।

ওমর ফারুক ইমন

লেখক: শিক্ষার্থী, গনিত বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।