মঙ্গলবার ২৯ জুলাই, ২০২৫

সমাজে বেড়েই চলছে বিবাহ বিচ্ছেদ

প্রতীকী ছবি/সংগৃহীত

বিবাহ একটি পবিত্র সামাজিক বন্ধন, যা মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি কেবল দুটি মানুষের নয়, বরং দুটি পরিবারের এবং বৃহৎ অর্থে একটি সমাজের মধ্যকার বন্ধনের প্রতিফলন। বিবাহ মানব জীবনে স্থিতিশীলতা, ভালোবাসা, পারস্পরিক নির্ভরতা ও বিশ্বাস গঠনের একটি অনন্য উপায়। কিন্তু বর্তমানে সমাজে এই স্থায়ী সম্পর্কটি যে হারে ভেঙে পড়ছে, তা সত্যিই আমাদের চিন্তায় ফেলেছে। দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ, পারিবারিক সহনশীলতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।

এক সময় বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল বিরল ঘটনা এবং সমাজে এর কটু নজর থাকত। এখন অনেকেই বিবাহ বিচ্ছেদকে আর তেমন সংকোচ বা লজ্জার বিষয় মনে করেন না। এটি সমাজে এক নতুন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক কাঠামোর উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, বেশিরভাগ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে বিয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই। এই অল্প সময়ের মধ্যেই কেন একটি দম্পতি একে অপরকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে, কেন পারস্পরিক সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার অভাব দেখা দিচ্ছে—তা আমাদের ভাবনার বিষয়।

বর্তমান সমাজে তরুণ-তরুণীরা অনেক বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক নিয়মশৃঙ্খলার চেয়ে তারা নিজেদের পছন্দ, স্বাধীনতা ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। বিয়ে তাদের কাছে একটি চুক্তির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সামান্য মতপার্থক্য বা ঝামেলা দেখা দিলেই বিচ্ছেদকে সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। অথচ বিবাহ একটি জীবনব্যাপী অঙ্গীকার, যেখানে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ—সবকিছু ভাগ করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে।

নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। তবে এর প্রভাব দাম্পত্য সম্পর্কেও পড়ছে। অনেক সময় দেখা যায়, একজন নারী যদি তার স্বামীর তুলনায় বেশি উপার্জন করেন, তাহলে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। স্বামী হীনমন্যতায় ভোগেন, আবার স্ত্রী নিজেকে স্বাধীন ভাবতে গিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যান। আবার যদি স্বামী উপার্জনক্ষম না হন বা যথেষ্ট সময় দিতে না পারেন, তখনও বিরোধ দেখা দেয়। এভাবেই আর্থিক বিষয় সম্পর্কের কেন্দ্রে চলে আসে এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গৌণ হয়ে যায়।

সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হলো, কর্মব্যস্ত জীবন। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী। ফলে সংসারের চাপে, সন্তানের দেখভালে কিংবা নিজের মানসিক বিশ্রামে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দাম্পত্য জীবনের আবেগ, রোমান্স, একসাথে সময় কাটানো, কথাবার্তা, ছোটখাটো ভ্রমণ—এসবের ঘাটতি তৈরি হয়। এই ঘাটতি থেকেই সম্পর্কের শীতলতা শুরু হয় এবং একসময় তা বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দাম্পত্য জীবনে নতুন মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার যেমন উপকারী, তেমনি এর অপব্যবহারও ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। এখন অনেক সম্পর্কেই দেখা যায়, স্বামী বা স্ত্রী অপরিচিত কারো সঙ্গে অতিমাত্রায় যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এই যোগাযোগ অনেক সময় গোপনীয়তা ভঙ্গ করে, যা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। দাম্পত্য সম্পর্কে যখন বিশ্বাসের অভাব ঘটে, তখন তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

বিচ্ছেদের আরেকটি বড় কারণ পারিবারিক হস্তক্ষেপ। অনেক সময় শ্বশুরবাড়ি বা নিজের পরিবারের সদস্যরা দম্পতির ব্যক্তিগত জীবনে অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপ করেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া কিংবা মতানৈক্য থাকলেও আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীরা বিষয়টিকে বড় করে তোলেন। এর ফলে সংকট গভীর হয়। বিশেষ করে মায়েরা যদি ছেলের পরিবারে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করেন, কিংবা কন্যাসন্তানের প্রতি তার বাবার পক্ষপাতিত্ব যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা জটিল রূপ ধারণ করে।

বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে করুণ ফল ভোগ করে সন্তান। একটি সুস্থ পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানের মধ্যে যেমন আত্মবিশ্বাস, সামাজিক শিষ্টাচার এবং মানসিক স্থিরতা থাকে, ঠিক তেমনই ভাঙা পরিবারে বড় হওয়া সন্তানের মধ্যে দেখা দেয় আত্মবিশ্বাসহীনতা, অনিশ্চয়তা ও মানসিক অস্থিরতা। অনেক ক্ষেত্রে তারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারায়, অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে, এমনকি মাদকাসক্তিও দেখা যায়। পারিবারিক সহানুভূতি ও ভালোবাসা না পেলে সন্তানরা বন্ধুবান্ধব, ইন্টারনেট বা টেলিভিশনের দিকে ঝুঁকে যায়, যা তাদের ভুল পথে পরিচালিত করে।

এই প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় অনুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ধর্মেই বিবাহকে পবিত্র ও গুরুত্ববহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদকে যদিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তবুও তা সর্বশেষ ও অনিচ্ছাকৃত সমাধান হিসেবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে বুঝতে পারেন, নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পারেন এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালনা করেন, তাহলে বিচ্ছেদের পরিস্থিতি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।

ছবি: ওসমান গণি/লেখক

এই সংকট নিরসনে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, সমাজে পারিবারিক শিক্ষা ও দাম্পত্য সম্পর্ক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পারিবারিক মূল্যবোধ ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিয়ের আগে ও পরে বাধ্যতামূলক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা দরকার। এতে করে নতুন দম্পতিরা সম্পর্কের জটিলতা সম্পর্কে ধারণা পাবেন এবং সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জন করবেন।

তৃতীয়ত, গণমাধ্যমে পরিবারকেন্দ্রিক ইতিবাচক বার্তা প্রচার করা দরকার। বর্তমানে অধিকাংশ টিভি নাটক ও সিনেমায় সম্পর্কের ভাঙন, অবিশ্বাস, প্রেমের বহুগামিতা দেখানো হয়। এতে করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটি ভ্রান্ত বার্তা পৌঁছে যায় যে, সম্পর্ক ভাঙা খুবই সাধারণ এবং দায়িত্ববোধহীনতা একটি আধুনিক বৈশিষ্ট্য। এসবের পরিবর্তে যদি ভালোবাসা, সম্মান, ত্যাগ এবং ধৈর্যের মতো গুণাবলি তুলে ধরা হয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

আইনি দিক থেকেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আদালত যেন বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতা ও পারিবারিক পরামর্শ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, সেটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অনেক সময় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হঠাৎ রাগ, হিংসা বা মানসিক অবসাদ থেকে নেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে অনুশোচনার জন্ম দেয়। সেখানে যদি একটি সুযোগ থাকে নিজেদের ভুল সংশোধনের, তাহলে বহু পরিবার রক্ষা পেতে পারে।

সবশেষে বলতেই হয়, বিবাহ একটি সম্পর্কের চেয়েও বড় কিছু—এটি একটি প্রতিষ্ঠান, যা সমাজের ভিত্তি তৈরি করে। এই প্রতিষ্ঠান যখন দুর্বল হয়ে যায়, তখন সমাজ তার ভারসাম্য হারায়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়ে, অপরাধ বাড়ে, মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ে এবং মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়।

তাই বিবাহ বিচ্ছেদ যেন সহজ সমাধান না হয়। সম্পর্কের জটিলতা নিরসনে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহানুভূতি, ক্ষমাশীলতা এবং দায়িত্বশীলতা দরকার। ছোটখাটো ভুলের জন্য সম্পর্ক ভাঙার পরিবর্তে আমাদের উচিত একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করা। পরিবার একটি বৃক্ষের মতো—যে যত্ন নেয়, সেই এর ছায়া পায়। আর যদি সেই বৃক্ষ উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে শুধু একক ব্যক্তি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা সমাজ।

বিবাহ বিচ্ছেদ আজ কেবল দুটি মানুষের আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা নয়, এটি একটি সামাজিক, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। দিন দিন সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে, কারণ আমরা ধৈর্য, সহানুভূতি ও ত্যাগের মূল্য ভুলে যাচ্ছি। ছোটখাটো ভুল কিংবা মতপার্থক্যই যখন বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে—পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার ঘাটতি গভীর। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু ভালোবাসা নয়, দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া, সময় দেয়া এবং একজন আরেকজনকে গুরুত্ব দেয়া।

প্রত্যেক সম্পর্কেই সমস্যা থাকে—কিন্তু সেই সমস্যাকে কীভাবে আমরা মোকাবিলা করি, সেটাই সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে। বিচ্ছেদ যেন শেষ বিকল্প হয়, কোনো আবেগপ্রবণ, তাড়াহুড়ো করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। পরিবার একটি বৃক্ষের মতো—যত্ন না নিলে তা শুকিয়ে যায়। সমাজে যদি সুখী পরিবার গড়ে তোলা যায়, তবে একটি সুস্থ প্রজন্ম, নিরাপদ সমাজ এবং ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। তাই পরিবারকে রক্ষা করাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।

ওসমান গনি
লেখক – সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন