জানুয়ারি ৭, ২০২৫

মঙ্গলবার ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ এর ভূমিকা ও অবদান

ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। এ অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং স্থাপত্যশৈলী বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

এই ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া – ASI” একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৬১ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহ্যামের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ভারতবর্ষের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত, সংরক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

ASI এর কাজ শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান ও সংরক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের অস্পষ্ট অধ্যায়গুলো উন্মোচন, প্রাচীন স্থাপত্য এবং শিল্পকর্মের নান্দনিকতা সংরক্ষণ এবং সেইসাথে সাধারণ জনগণের মধ্যে ঐতিহ্যের গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন যেমন মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা সভ্যতা, এলিফ্যান্টা গুহা, কুতুব মিনার, তাজমহল, এবং খাজুরাহো মন্দির সহ অন্যান্য নিদর্শনগুলোর সংরক্ষণে ASI ভূমিকা এবং এর অবদান অনস্বীকার্য।

এই সংস্থার গবেষণা কার্যক্রম কেবল ভারতের সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক গবেষণায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটের ডিজিটাল ম্যাপিং, এবং নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের আবিষ্কার ASI এর ভূমিকা কে আরো শক্তিশালী করেছে।
এভাবে “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া” শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহাসিক ধারার প্রগতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বিকাশে এর ভূমিকা অপরিসীম এবং ভবিষ্যতেও এই সংস্থার অবদান আরও বিস্তৃত হতে থাকবে।

প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক কার্যক্রম

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (ASI) প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ প্রকৌশলী ও প্রত্নতত্ত্ববিদ (স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম) কে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ও ঐতিহ্যগুলো অবহেলার কারণে নষ্ট হচ্ছে। ১৮৬১ সালে ASI প্রতিষ্ঠার পর প্রথম লক্ষ্য ছিল প্রাচীন মুদ্রা, শিলালিপি, স্থাপত্য এবং মন্দিরের নিদর্শনগুলো শনাক্ত ও নথিভুক্ত করা। কানিংহাম প্রাচীন শহর পাটালিপুত্র, সারনাথ, এবং বুদ্ধগয়ার মতো স্থানগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরেন।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল যে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামকে ASI এর প্রথম মহাপরিচালক (Director General) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে পুরাকীর্তির তালিকা তৈরি করেন।

গবেষণার প্রসার

কানিংহামের নেতৃত্বে ASI প্রথমে বৌদ্ধ স্থাপত্য এবং মূর্তির ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। যেমন: সাঁচি, সারনাথ, এবং বোধগয়া। পরবর্তীকালে, গুপ্ত যুগের মুদ্রা, মগধের রাজধানী রাজগৃহ, এবং হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করে।

অঞ্চলভিত্তিক গবেষণা

ASI বিভিন্ন অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ: তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, এবং ফতেহপুর সিক্রি, মহাবলীপুরম, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের হাম্পি, কনার্কের সূর্যমন্দির, নালন্দা মহাবিহার, এলিফ্যান্টা গুহা এবং অজন্তা-ইলোরা এর মত নিদর্শনের সংরক্ষণ।

প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ এবং খনন কার্যক্রম

ASI এর অন্যতম প্রধান কাজ হলো প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ এবং খনন কার্যক্রম পরিচালনা। সংস্থাটি সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান আবিষ্কার করেছে। এছাড়া, অজন্তা-ইলোরা গুহা, সাঁচি স্তূপ, এবং মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলো ASI এর গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করেছে।

ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার

ASI ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাজমহল, কুতুব মিনার, এবং খাজুরাহোর মন্দির সংরক্ষণে সংস্থাটির ভূমিকা প্রশংসনীয়।

পুরাতত্ত্ব এবং সংস্কৃতি শিক্ষার বিকাশ

ASI শুধুমাত্র নিদর্শন খননেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিক্ষাকে আরও প্রসারিত করেছে। বিভিন্ন প্রকাশনা, জার্নাল এবং প্রতিবেদনের মাধ্যমে তারা ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

স্থাপত্য পুনর্গঠন

অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্য নিদর্শন পুনর্নির্মাণ করে ASI ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি এবং আগ্রা ফোর্টের মতো স্থাপত্যগুলোর পুনঃসংরক্ষণ।

হেরিটেজ ম্যানেজমেন্ট

বর্তমানে ASI ভারতের বিভিন্ন স্থানে “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” হিসেবে স্বীকৃত স্থানগুলোর সুরক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৩ সালে তাজমহলকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় ASI এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনা

ASI প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফল নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে। “Annual Reports of the Archaeological Survey of India” এবং “Indian Archaeology – A Review” তাদের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম

ASI নতুন প্রজন্মের প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সংস্থাটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগেও দক্ষ।

আইনি সুরক্ষা

১৯৫৮ সালের “প্রাচীন স্মারক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট ও অবশেষ আইন” (Ancient Monuments and Archaeological Sites and Remains Act) ASI এর মাধ্যমে কার্যকর হয়, যা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষায় একটি মাইলফলক।

গবেষণার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

ASI বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এবং গবেষণার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি যেমন: লেজার স্ক্যানিং, ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার ব্যবহার সহ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। এই প্রযুক্তি প্রাচীন স্থানগুলোর ইতিহাস আরও নির্ভুলভাবে নির্ধারণে সহায়তা করেছে।

প্রত্নতত্ত্ব এবং পর্যটন

ASI প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর সংরক্ষণের পাশাপাশি পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এটি ভারতের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি জনগণের আগ্রহ বাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তাজমহল, আম্বার ফোর্ট, এবং খাজুরাহোর মন্দির পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় স্থান।

পরিশেষে বলতে হয়, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া – ASI” এক অনন্য প্রতিষ্ঠানের নাম, যা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ভারতবর্ষের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা ও নিদর্শনগুলোর সংরক্ষণ এবং প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।

ASI এর কাজের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রটি কেবলমাত্র নতুন তথ্য আবিষ্কার এবং অধ্যয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের সচেতনতা ও আগ্রহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর মতো প্রাচীন সভ্যতার সন্ধান, অজন্তা ও ইলোরা গুহার মতো শিল্পকলার নিদর্শন সংরক্ষণ, এবং তাজমহল, কুতুব মিনার বা খাজুরাহো মন্দির সহ অন্যান্য স্থাপত্যিক কীর্তিগুলো সংরক্ষণ করে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অমূল্য ভাণ্ডার সংরক্ষণ করেছে।

এছাড়াও, ASI বিভিন্ন গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা বিনিময় এবং সহযোগিতার মাধ্যমে তারা প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে, “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া” কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাদের প্রচেষ্টা শুধু অতীতকে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের ঐতিহ্যের প্রতি গর্ববোধ এবং ইতিহাসের গভীরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ASI এর অবদান তাই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

 ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।