জুলাই ৫, ২০২৫

শনিবার ৫ জুলাই, ২০২৫

বর্ষায় জলাবদ্ধ বাংলাদেশ: সমস্যা, সংকট এবং উত্তরণের উপায়

RisingCumilla.Com - floods in Brahmanpara, Cumilla
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যেই হলো বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, ফলে প্লাবন, জলাবদ্ধতা ও বন্যা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্ষার প্রকৃতি যেমন বদলেছে, তেমনি শহর ও গ্রামীণ অবকাঠামোগত দুর্বলতার প্রভাবে জলাবদ্ধতা আজ একটি ভয়াবহ সংকটের রূপ নিয়েছে।

বিশেষত রাজধানী শহর ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, খুলনা, বাংলাদেশের লন্ডন খ্যাত সিলেট ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে বর্ষাকাল মানেই অচলাবস্থার শঙ্কা, জনদুর্ভোগ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা।

বাংলাদেশে জলাবদ্ধতা প্রধানত দুই ধরনের; স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে এবং মানবসৃষ্ট কারণে। প্রাকৃতিকভাবে অতিবৃষ্টি, নদীর পানির স্তর বৃদ্ধি এবং নিম্নভূমিতে পানি জমে থাকা জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজকের জলাবদ্ধতার পেছনে মানুষের ভূমিকা অনেক বেশি।

অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাশয় ও খাল-বিল-নালার দখল, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অকার্যকারিতা, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পলিথিন ও কঠিন বর্জ্য দ্বারা ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া; এসবই বর্ষাকালে জলাবদ্ধতাকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।

বিশেষ করে ঢাকা শহরকে যদি আমরা দেখি, তাহলে বোঝা যায় যে এই শহর একসময় খাল, বিল, জলাশয় ও নদীঘেরা একটি জলসম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নগর সম্প্রসারণের অজুহাতে জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ, খাল দখল করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক স্থাপনা এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার ধ্বংসযজ্ঞ; সবকিছুই শহরের স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে।

ঢাকার ড্রেন ও খালগুলোর অধিকাংশই এখন কচুরিপানা, বর্জ্য ও দখলে ভরা। ফলে কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতেই নগরীর অবস্থা রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে ও থমকে যায় জনজীবন।

চট্টগ্রাম শহরের পরিস্থিতি আরও জটিল। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান, পাহাড়ি এলাকা ও নীচু অঞ্চল মিলিয়ে বর্ষাকালে পাহাড় ধস ও অতিবৃষ্টির ফলে আকস্মিক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

পাশাপাশি পাহাড় কেটে জনবসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুলনা অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সাথে যুক্ত হয়েছে লবণাক্ততা ও নদীভাঙনের মত সমস্যা, যা কৃষিজমি ও জীব-বৈচিত্র্যকে চরম মাত্রায় হুমকির মুখে ফেলেছে।

এই ধরণের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জলাবদ্ধতার ফলে সড়কে দীর্ঘ যানজট, অফিস-স্কুলে যেতে বিলম্ব, ঘরের ভেতরে পানি প্রবেশ করে গৃহস্থালির জিনিস নষ্ট হওয়া, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, বাজার-হাসপাতালে যেতে সমস্যা হওয়া, এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

জলাবদ্ধ পানিতে মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায়, ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসী, এ সময় চরম দুর্দশায় পতিত হয়।

এই সংকটের উত্তরণে প্রয়োজন বহুমাত্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগ:

প্রথমত, শহরাঞ্চলে ড্রেনেজ ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন অপরিহার্য করতে হবে। খাল ও জলাশয়গুলো চিহ্নিত ও দখলমুক্ত করে যথাযথভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের প্রতিটি এলাকায় বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা ও নানাবিধ রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম চালু করা উচিত। অপরিকল্পিত ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং নগর পরিকল্পনায় পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ নিরবচ্ছিন্ন রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ড্রেনে পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত বর্জ্য ফেলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে এবং নাগরিকদের মধ্যে পরিবেশ-সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বর্ষাকালে জরুরি মুহূর্তে দ্রুত পানি নিষ্কাশন ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান নিশ্চিত করা যায়।

তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে “ব্লু অ্যান্ড গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার” কে গুরুত্ব দিতে হবে। শহরে সবুজ অঞ্চল, উদ্যান, পার্ক ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে, যা বর্ষার পানি শোষণে সহায়ক হবে। একইসাথে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণের ওপর জোর দিতে হবে।

চতুর্থত, জনসচেতনতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে নিশ্চিত করা জরুরি। জলাবদ্ধতা রোধে শুধু সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। বাড়ির ড্রেন পরিষ্কার রাখা, পলিথিন ব্যবহার না করা, খাল দখলে সহায়তা না করা; এসব ছোট উদ্যোগ সামষ্টিকভাবে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাতে হবে। বেশি বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে, সেটি ধরে নিয়েই নগর অবকাঠামো নির্মাণ ও জলব্যবস্থাপনার খসড়া তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় আগাম বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার পূর্বাভাস প্রদান ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।

সবশেষে একটি কথাই বলতে হয়, বর্ষার জলাবদ্ধতা শুধু একটি মৌসুমি দুর্ভোগ নয়, এটি এখন একটি জাতীয় সংকট। এই সংকটের সমাধান শুধু প্রকৌশল ভিত্তিক নয়, পরিবেশগত, সামাজিক ও নীতিগত পদক্ষেপের সমন্বয়ের মাধ্যমে আসতে পারে।

বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যতের একটি বাসযোগ্য, টেকসই এবং উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সময় থাকতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, এবং জনগণকেও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে ও যথেষ্ট দায়িত্বশীল হতে হবে; প্রতিবন্ধকতা নয়, বর্ষাকাল হয়ে উঠুক সম্ভাবনার বার্তাবাহক।

আরও পড়ুন