ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫

শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মন্তব্যে ক্ষোভ, শিক্ষকদের নিঃশর্ত ক্ষমার দাবি

Rising Cumilla - Outrage over Barisal University VC's comments, teachers demand unconditional apology
ছবি: প্রতিনিধি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং উপাচার্যের শিক্ষকদের ‘ফ্যাসিস্ট’ বলার মন্তব্যের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের শিক্ষকরা। সেখানে তাঁরা উপাচার্যকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান।

সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে বারোটায় আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা জানান, বিগত কয়েকদিন ধরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মধ্যে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার অন্যতম কারণ উপাচার্যের বিতর্কিত মন্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে সম্বোধন করায় তাঁরা ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, উপাচার্য ড. শুচিতা শারমিন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো শিক্ষাঙ্গনকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই একসময় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময়ে শিক্ষকদের একটি বড় অংশও সাহসী ভূমিকা রেখে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন, নির্যাতন ও হয়রানির ভয় উপেক্ষা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

শিক্ষকরা আরও অভিযোগ করেন, বর্তমান উপাচার্য নিজেই অতীতে ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালের একটি বিতর্কিত নির্বাচনের পক্ষে বিভিন্ন বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা যে সমর্থনসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর নাম ১০৮ নম্বরে ছিল। একজন চিহ্নিত ফ্যাসিবাদ-সমর্থক ব্যক্তি এখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলছেন, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয়।

শিক্ষকরা উপাচার্যের এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি যদি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা না চান, তাহলে তাঁরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।

এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনের তাদের অন্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:

১। এছাড়াও তিনি উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এযাবৎকালের সকল নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এই কথা দ্বারা তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে আহত করেছেন। আমরা তাঁর এই বক্তব্যেরও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এই কথার জন্যও তাকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নিকট ক্ষমা চাইতে হবে।

২। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বিগত পাঁচ মাসেও তিনি একটি সিন্ডকেট সভা ডাকতে পারেননি, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৮(২) ধারামতে প্রতি ৩ মাসে একটি সিন্ডিকেট সভা আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত গত ১১/২/২০২৫ তারিখে এ মর্মে পত্র দেয়া হয় যে, ১৪/২/২০২৫ তারিখ বিকাল ৩:০০টায় ভিসির বাসভবনে একটি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীন আমাদের জানিয়েছেন যে, উক্ত আহ্বানপত্রের সাথে কোনো আলোচ্যসূচি দেয়া হয়েছিল না।

এমনকি ১৪/২/২০২৫ তারিখ বিকাল ৩:০০টার মধ্যেও সদস্যদেরকে কোনো আলোচ্যসূচি জানানো হয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনুমিত হয় যে, এটি ছিল একটি গোপন এজেন্ডার দুরভিসন্ধিমূলক সিন্ডিকেট সভা। শিক্ষার্থীরা এই সিন্ডিকেট সভা না হতে দেয়ার লক্ষ্যে ভিসির বাসভবনের মূল গেটের সামনে জড়ো হয়ে সদস্যদেরকে ঢুকতে বাঁধা দেয়।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রোভিসি মহোদয়, ট্রেজারার মহোদয় ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীন গেটে অপেক্ষা করতে থাকেন যাতে প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় হলেও তাঁরা সভায় ঢুকতে পারেন। কিন্তু আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তাঁরা ঢুকতে পারেন না। তখন রেজিস্ট্রার তাদের একজনকে জানান যে সভাটি একমাত্র আলোচ্য বিষয়ের বিশেষ সভায় রূপান্তর করা হয়েছে এবং তাঁরা যেন অনলাইনে সভায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তখন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে অনলাইনে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগই ছিল না। কার্যদৃষ্টে মনে হয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেই ছিল এই সদস্যগণ যাতে আলোচনায় কার্যকর অংশগ্রহণ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা।

এছাড়াও সদস্যগণের বিবেচনা অনুযায়ী সেই একমাত্র আলোচ্যবিষয়টি আইনিভাবে বৈধ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠার যোগ্য ছিল না। আলোচ্যবিষয়টি ছিল-‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শৃঙ্খলা বোর্ড বা সংবিধি না হওয়া পর্যন্ত সরকারী কর্মচারী আইন অনুযায়ী শৃঙ্খলা আইন প্রযোজ্য হবে মর্মে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ’। খুবই অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর এক আলোচ্য বিষয়। শৃঙ্খলা বোর্ড কীভাবে সংবিধির বিকল্প হতে পারে আল্লাহ মালুম। শৃঙ্খলা আইন নামে বাংলাদেশে কোন আইন আছে বলে আমরা শুনিনি। এছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ ধারায় সংবিধি ও বিধি প্রণয়নের যে বিধান রয়েছে তদনুযায়ী সরকারি কোনো বিধি এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সর্বোপরি আলোচ্যবিষয়টি যেভাবে লেখা হয়েছে তাতে দেখা যায় উক্ত সরকারি আইন বা বিধি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে- এমন সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে তারপরে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে যা কার্যত আর আলোচনার সুযোগই রাখে না। এই সব বিবেচনায় নিয়ে উক্ত তিনজন সদস্য সভাটি বয়কট করেন। কিন্তু জানা যাচ্ছে, স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সদস্যের অংশগ্রহণ ব্যতীতই উক্ত সভা অনলাইনে সম্পন্ন করেছেন এবং সেখানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ ধারার নির্দেশনা অমান্য করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য তৈরিকৃত আইন বা বিধি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। এরূপ সিদ্ধান্ত অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়াত্ত্বশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং ইহা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইন্টেলেকচুয়াল ও একাডেমিক স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে হরণ করবে বলে আমরা মনে করি। তাই এই অবৈধ সিদ্ধান্তের (যদি হয়ে থাকে) আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে তা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।

৩। ১৪/২/২০২৫ তারিখের ছাত্রবিক্ষোভ বিষয়ে উপাচার্যের নির্দেশে মামলা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি এবং সেই মামলার এজাহারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি মহোদয়, ট্রেজারার মহোদয় ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্যের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও ট্রেজারারের বিরুদ্ধে এমন মামলার এজাহারে অভিযোগের ঘটনা অত্যন্ত নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক। আমরা এই ঘটনারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এই অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

৪। একইসাথে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সকল মামলার আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের সকল ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবির প্রতিও আমরা সুদৃঢ় সহমত পোষণ করছি।

আমাদের এই প্রতিবাদ বিবেচনায় নিয়ে সকল দাবি অবিলম্বে পূরণপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উপাচার্য মহোদয়কে অনুরোধ করছি। এই অনুরোধ উপেক্ষা করা হলে শিক্ষক সমাজ কঠিনতর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।