সোমবার ১১ আগস্ট, ২০২৫

বডি শেমিং একটা সামাজিক ব্যাধি

লেখক: শাম্মী তুলতুল

বডি শেমিং একটা সামাজিক ব্যাধি
বডি শেমিং একটা সামাজিক ব্যাধি/গ্রাফিক্স: রাইজিং কুমিল্লা/আই জেনারেটেড

মিতুল দেখতে অনেক মোটা। পড়ে ক্লাস ফাইভে। মোটা শরীর বলে সে কোথাও খেলতে যেতে পারে না। ঘুরতে যেতে পারে না। স্কুলে তাকে সবাই ক্ষেপায়। এমনকি শিক্ষকরাও। বন্ধুরা তাকে দেখলেই মুখ ভেংচি দেয়। বন্ধুত্ব করে না । মোটু মোটু বলতে থাকে। এভাবে অনেক দিন কেটে যাওয়ার পর মিতুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। একদিন দুদিন গেল।কিন্তু বাবা মা কিছু টের পেলনা। দুদিন পর যখন আর স্কুলে যেতে চাইছেনা মিতুল রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তখন মা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তোমার কয়দিন ধরে স্কুলে যাওনা আমায় বল?

মিতুল তার বাবাকে খুব ভয় পায়। সে বাবার ভয়ে মাকে কিছু বলছেনা। কিন্তু মা খুব চিন্তিত তার এই আচরণে।

মিতুলের বাবা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তার। মা একটা না একটা কথা বলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু কদ্দিন? বাবার চোখে ঠিকই ধরা পরে। বাসায় স্কুল টিচার তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে।

বাসার টিচার তাকে একদিন খুব আদর করে হাতে চকোলেট দিয়ে জিজ্ঞেস করে তোমার কি হয়েছে কদিন ধরে স্কুলে যাওনা, পড়ায় মন নাই কি হয়েছে তোমার? আমি তোমার শিক্ষক । বন্ধুর মতোই তাইনা?

জী । আমি কি কোনদিন তোমায় মেরেছি?

না টিচার।

তাহলে আমায় বলতে কোন সমস্যা নেই তোমার নির্ভয়ে বলতে পারো।

আমার কি হয়েছে শুনবেন ?

হুমম নিশ্চয় শুনব।

আব্বুকে বলবেন নাত?

না বলব না।

আব্বু জানলে আমাকে মারবে।

সত্যি বলব না তোমার বাবাকে।

স্কুলে আমার বন্ধুরা আমাকে ক্ষেপায়।

কেন?আমি মোটা বলে তাই।

ওহ।

আমি খুব মোটা খুব খায়। আমার শিক্ষকরাও অনেকে খোঁচায়।

টিচার প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারলনা। শান্তনাটা গুছিয়ে বলতে হবে তাই সেদিন শুধু শুনে গেলো। পরের দিন টিচার তাকে কোলে বসিয়ে বলে, তুমি কি জান আমরা যারা চিকন তাদের হাড্ডি বলে ক্ষেপায় লোকে। কথাটা শুনে মিতুলের মুখে হাসি হা হা করে সে হেসে দিল সে।

স্কুলেও আমাকে চিকনা বলত। একে বডি শেমিং বলে।

এর অর্থ কি টিচার?

এর অর্থ হল কারও গায়ের আকার, ওজন নিয়ে সমালোচনা করা। যাতে সেই মানুষটি লজ্জাবোধ করেন বা অপমানিত হন তাকে বডি শেমিং বলে। সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে, মোটকা, চিকনা ও বাটু ইত্যাদি নামে মানুষকে ডাকা তাই বডি শেমিং।

আমি যে চিকন আমার মা আমাকে খুব খোঁচা মারে।স্কুলেও আমাকে চিকনা বলত।

সত্যি, মিতুল চমকে যায়।

হুমম চার সত্যি।

তাই বলে কি স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি? আমি আরও বেশি করে গিয়েছি। কেউ তোমাকে মোটা বলুক তুমি কি ওদের খেয়ে মোটা হয়েছে নাকি। তুমি বরং ওদের বলবে আমি মোটা বেশ হয়েছে আরও খেয়ে আরও মোটা হব।

তাতে তোমাদের কি। তুমি যখন লিখা পড়া করে ভালো রেজাল্ট করবে দেখবে ওরা কেউ তোমার ধারে কাছেও আসবে না ।হা করে তাকিয়ে থাকবে।ঠিক আছে?

মিতুল মাথা নাড়ে।আব্বুকে বলনা আব্বু আমাকে মারবে।

কে বলছে আব্বু মারবে তোমার আব্বু তোমাকে অনেক আদর করেন, ভালোবাসেন। দেখবে তিনি তোমাকে আমার মতো আদর করে সব বুঝিয়ে বলবে । দূর থেকে মা সব কথা শুনে অবাক হলেন। তার চোখ

ছলছল ছেলের কথা শুনে। কেঁদে দিলেন। মনে মনে বলেন,আমার বাচ্চাটা কি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে মা হয়ে টের পেলাম না। কি ধরনের মা হলাম। আজ ঘরের টিচার থেকে সব জানতে পারলাম। মা রাতে বাবার কাছে সব খুলে বলেন। বাবা সব শুনে দুঃখ প্রকাশ করেন, আমার এতটুকুন একটা বাচ্চা আমাকে এত ভয় পায় আমিত জানতামই না।

মা বলেন, দেখ শিশুদের কাছে বাবা মাকে বন্ধু হতে হয় আজ আমরা ওর মনের কথা জানতে পারলাম না। সে তার গৃহ শিক্ষিকা সব বলল।

বাবা মা দুজনে বাচ্চার রুমে গিয়ে বসল। ছেলের দিকে তাকিয়ে মা হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। সমাজের মানুষ এমন কেন একটা ছোট শিশু তাকে মোটা বলে ক্ষেপাতে হয়।

বাবা বলেন, ভেবনা আমি কাল প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলব এই ব্যাপারে । আমরা তার বন্ধু হয়ে তার পাশে থাকব। সকালে মা- বাবা দুজনে তার রুমে এসে হাজির। বাবা বড় একটি কেক এনে মিতুলের সামনে রাখল।

মিতুল দেখে অবাক। একি আব্বু কেক কেন আজ ত আমার জন্মদিন না।

জন্মদিন না ঠিক কিন্তু আজ হ্যাপি ফ্রাইডে । আজ আমার বাবা কেক কাটবে। খাবে। আজ আমরা সারাদিন বেড়াতে যাব। কাল এই কেক তোমার বন্ধুদের জন্য নিয়ে যাবে।

স্কুলে?

হুমম। তোমার বন্ধুদের সাথে কথা বলব।কেউ তোমাকে মোটা বলবে না।

সত্যি ?

হ্যাঁ বাবা। মুহূর্তেই মিতুলের মন ভালো হয়ে গেলো।

পরের দিন তারা সবাই স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে আলোচনা করলেন। প্রিন্সিপাল শুনে খুব লজ্জা পেলেন। তিনি স্কুলের টিফিন ছুটিতে সব বাচ্চাদের এই ব্যাপারে বোঝালেন । বলেন, এখানে শুধু মিতুল মোটা নয় আরও অনেক বাচ্চা আছে।

তোমার পরিবারেও আছে তাই বলে কি তাদের তোমরা ক্ষেপাও?সব ছাত্র- ছাত্রী তখন মাথা নীচু করে রইল। সেই থেকে মিতুলের স্কুলে বডি শেমিং নিয়ে প্রত্যেক শিক্ষক সব ছাত্র- ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে উপদেশ দেন।

পাদটীকা— বডি শেমিং একটা সামাজিক ব্যাধি। এটি বাচ্চাদের জন্য খুব মারাত্মক। তাই শিক্ষকদের উচিত অন্তত স্কুলে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া।

আরও পড়ুন