দিনাজপুরের গ্রামীণ নারীরা হাঁস পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলার গৃহবধূরা এখন চীনের বিখ্যাত পিকিং বা পেকিন জাতের হাঁস পালন করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে এই হাঁস পালন করে অনেকেই এখন লাখ টাকা আয় করছেন।
চিরিরবন্দর উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা সাইদুর রহমানের স্ত্রী আসমা বেগম (৩২) জানান, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর সহায়তায় গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি স্বল্প মূল্যে ৩০টি পেকিন হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করেন। বাড়ির আঙিনায় টিনের ঘরে জাল দিয়ে ঘের তৈরি করে তিনি এই হাঁসের বাচ্চাগুলো লালন-পালন শুরু করেন। নিয়মিত খাবার, জল সরবরাহ এবং পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দিনের বেলায় হাঁসগুলোকে মাঠে ঘাস খাওয়ানো ও পুকুরে সাঁতার কাটার সুযোগ দেন তিনি। হাঁসের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় থাকে খুদের ভাত, গমের ভুসি ও অন্যান্য দানাদার খাদ্য।
আসমা বেগম আরও জানান, মাত্র দুই মাসের মধ্যেই প্রতিটি হাঁসের ওজন তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হয় এবং এগুলো বিক্রির উপযুক্ত হয়ে ওঠে। প্রথম দফায় তিনি ২৮টি হাঁস প্রতি পিস ১২০০ টাকা দরে বিক্রি করে ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা লাভ করেন। এরপর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি আরও দুই দফায় ৫৬টি হাঁস একই দামে বিক্রি করে মোট ৬৭ হাজার ২০০ টাকা আয় করেছেন। তৃতীয় দফায় ৩০টি হাঁস তিনি এপ্রিলের শুরুতে ১৩০০ টাকা দরে বিক্রি করে আরও ৩৯ হাজার টাকা লাভ করেন। ঈদ-উল-ফিতরের কারণে সে সময় হাঁসের দাম কিছুটা বেশি ছিল বলে জানান তিনি। বর্তমানে তিনি চতুর্থ দফায় ৩৫টি পেকিন হাঁসের বাচ্চার জন্য অর্ডার দিয়েছেন এবং আগামী ১০ এপ্রিল নাগাদ সেগুলো হাতে পাবেন বলে আশা রাখছেন। তিনি জানান, এনজিও থেকে প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা ৩৫ টাকা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।
পেকিন হাঁসের মাংসের গুণাগুণ সম্পর্কে আসমা বেগম বলেন, দেশি হাঁসের তুলনায় এই হাঁসের মাংসের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেশি এবং হাড়ের পরিমাণ খুবই কম। ফলে হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছেও এই হাঁসের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এর মাংস যেমন বেশি, তেমনই খেতেও খুব সুস্বাদু।
পিকেএসএফের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যেই পিকেএসএফ এই উদ্যোগ নিয়েছে। দিনাজপুরে ইতিমধ্যেই ২৫ জন গ্রামীণ নারী পেকিন হাঁস পালন করে সফল হয়েছেন।
জানা গেছে, পেকিন হাঁস পালনে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই এবং রোগবালাইও তুলনামূলকভাবে কম। এই হাঁসের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পিকেএসএফের সহায়তায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মহিলা বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র (এমবিএসকে) দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ২৫ জন গৃহবধূকে এই হাঁস পালন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বর্তমানে দিনাজপুর সদর, আস্করপুর, বিরল উপজেলার বিশ্বনাথপুর এবং চিরিরবন্দর উপজেলার তেঁতুলিয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ‘মাংসের জন্য ব্রয়লার টাইপ পেকিন জাতের হাঁস পালন’ একটি জনপ্রিয় উদ্যোগে পরিণত হয়েছে।
এমবিএসকের সদস্য লাবণ্য রানি, প্রতিমা রায়, বুলবুলি, মর্জিনা, সোহেলী, ময়ূরী, শর্মিলা দাস, সালেহা বেগম, আসমা বেগম, মর্জিনা খাতুনসহ ২৫ জন নারী পেকিন হাঁস পালন করে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। বিশ্বের জনপ্রিয় ব্রয়লার টাইপ হিসেবে পরিচিত চীনের এই পেকিন হাঁস ৬০ থেকে ৬২ দিনের মধ্যে ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি ওজন হয়ে থাকে। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
পেকিন জাতের হাঁস পালনে তেমন কোনো বাড়তি পরিচর্যা বা ঝামেলার প্রয়োজন হয় না। রোগ-বালাই কম হওয়ায় এই হাঁসের মৃত্যুর হারও অনেক কম। ফলে দরিদ্র খামারিরা অল্প খরচ ও পরিশ্রমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রথম পর্যায়ে বিনামূল্যে এবং পরবর্তীতে স্বল্পমূল্যে হাঁসের বাচ্চা ও খাদ্য সহায়তা পেয়ে সুবিধাভোগী পরিবারগুলো অত্যন্ত খুশি।
এমবিএসকে অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে এই হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে গ্রামীণ নারীদের সরবরাহ করে এবং হাঁস পালনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে। নারীদের স্বাবলম্বী করার এই উদ্যোগ ইতিমধ্যেই এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
দিনাজপুর জেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুর রহিম বলেন, চীনের উন্নত জাতের পেকিন হাঁস পালন করে গ্রামীণ নারীরা যে সফলতা অর্জন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রাণী সম্পদ বিভাগ গ্রামীণ নারীদের এ ধরনের উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি পালনে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC