
হিজরি বর্ষের অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ মাস জিলহজ। এই মাসের নবম তারিখ মুসলিম বিশ্বে ‘ইয়াউমুল আরাফা’ বা আরাফার দিন নামে পরিচিত। আরবি চান্দ্রবর্ষের এই মাসটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। পাশাপাশি রজব, জিলকদ ও মহররম মাসও ইসলামে বিশেষভাবে সম্মানিত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরাফার দিনের রোজার ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তা বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে দেবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)। এই হাদিস মুসলিম উম্মাহর কাছে দিনটির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরাফার দিনের নামকরণের কারণ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং হাদিসের আলোকে এর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়:
১. স্বপ্নের ব্যাখ্যা: কারো কারো মতে, ইবরাহিম (আ.) ৮ জিলহজ রাতে পুত্রকে জবাই করার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু স্বপ্নের অর্থ স্পষ্ট না হওয়ায় তিনি চিন্তিত ছিলেন। পরবর্তীতে ৯ জিলহজ একই স্বপ্ন দেখলে এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন। এই ঘটনার স্মরণে ৯ জিলহজ ‘আরাফার দিন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ‘আরাফা’ শব্দের অর্থ জানা বা চেনা। (তাফসিরে বাগাবি ৭/৪৮)
২. জিবরাঈল (আ.)-এর শিক্ষা: অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, জিবরাঈল (আ.) ৯ জিলহজ তারিখে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হজের বিভিন্ন আমল সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। ‘আরাফা’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘জানা’। এই কারণেও দিনটি আরাফার দিন হিসেবে পরিচিত হতে পারে। (আল-বিনায়া ৪/২১১)
৩. আরাফা প্রান্তরে অবস্থান: আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, এই দিনে হজযাত্রীরা হজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মক্কার অদূরে অবস্থিত ‘আরাফা’ নামক প্রান্তরে অবস্থান করেন। এই অবস্থানের কারণেও ৯ জিলহজ ‘আরাফার দিন’ হিসেবে পরিচিত। (আল-ইনসাফ ৩/২৪৪)
তবে উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আরাফার দিনের নামকরণের একমাত্র কারণ আরাফা প্রান্তরে হজযাত্রীদের অবস্থান নয়, বরং এর ঐতিহাসিক ও পারিভাষিক তাৎপর্যও রয়েছে।
অতএব, ইসলামিক পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আরাফার দিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানের চেয়ে জিলহজ মাসের নবম তারিখটিই মুখ্য। অর্থাৎ, বিশ্বের যে প্রান্তে যেদিন জিলহজের ৯ তারিখ হবে, সেই দেশের মুসলিমদের জন্য সেটাই আরাফার দিন হিসেবে গণ্য হবে। হজযাত্রীদের আরাফার ময়দানে অবস্থানের সঙ্গে অন্যান্য দেশের মুসলিমদের রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা নেই।
আরাফার রোজা: দেশভিত্তিক তারিখের গুরুত্ব
হাদিসের ফজিলত লাভের জন্য বিশ্বের সকল মুসলিম তাদের নিজ নিজ দেশের তারিখ অনুযায়ী জিলহজের ৯ তারিখে রোজা পালন করবেন। এই রোজার ফজিলত আরাফার ময়দানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, বরং এটি ওই নির্দিষ্ট তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কারণেই হজযাত্রীদের জন্য আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে রোজা না রাখাই উত্তম। বিশুদ্ধ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আরাফায় অবস্থানকালে রোজা না রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৮৮)
এর মূল কারণ হলো, এই রোজার সম্পর্ক জিলহজ মাসের ৯ তারিখের সঙ্গে। যেদিন যে দেশে ৯ জিলহজ হবে, সেখানকার মুসলিমদের জন্য সেটাই ‘ইয়াওমে আরাফা’। ঈদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। দূরবর্তী দেশগুলোর জন্য আরবের তারিখের সঙ্গে এক বা দুই দিনের পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক এবং সেক্ষেত্রে নিজ দেশের তারিখ অনুযায়ী ঈদ পালনের বিধান রয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৮৭)
উপরন্তু, পূর্বে উল্লেখিত মুসলিম শরিফের হাদিসে আরাফার দিনের রোজা বলতে যে ৯ জিলহজের কথা বলা হয়েছে, তা অন্যান্য হাদিস দ্বারা আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীগণের একজন বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ৯ জিলহজ তারিখে রোজা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৭, সুনানে নাসাই, হাদিস : ২৩৭২)
সুতরাং, মুসলিম উম্মাহর উচিত নিজ নিজ দেশের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জিলহজের ৯ তারিখে আরাফার রোজা পালন করা এবং এই দিনের বিশেষ ফজিলত অর্জন করা।