জানুয়ারি ১২, ২০২৫

রবিবার ১২ জানুয়ারি, ২০২৫

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: গৌরব ও সাফল্যের ৫৫ বছর

Amar Ekushey JU
ছবি: লেখক

আজ ১২ জানুয়ারি, ৫৫ বছরে পদার্পণ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। মহুয়া আর চন্দ্র মল্লিকার সৌরভে সুরভিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে কেন্দ্র করে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে জাহাঙ্গীরনগর

রাজধানী শহর ঢাকা থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ থাকলেও আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPATC) কে ৫০ একর জমি ছেড়ে দেওয়ার ফলে বর্তমানে এর পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ৭০০ একরে (৬৯৭.৫৬ একর)। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকেই ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে এর যাত্রা শুরু হয়।

কিন্তু ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে এর নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস.এম আহসান।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগ (অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশ, গণিত, পরিসংখ্যান) ২১ জন শিক্ষক আর ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন ৬ টি অনুষদের অধীনে ৩৪ টি বিভাগ ও ৪ টি ইন্সটিটিউটের গুণী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।

শিক্ষায় জাহাঙ্গীরনগর

১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন (অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ), বর্তমান উপাচার্য (অধ্যাপক ড. মো কামরুল আহসান)। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে। যাদের মধ্যে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াত মামুদ, হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, মুস্তফা নূরুল ইসলাম, আবু রুশদ মতিনউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, ইতিহাসবিদ বজলুর রহমান খান, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, এ.এ মামুন, তারেক শামসুর রহমানের মতো দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের স্মৃতিতে ধন্য হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

বিভিন্ন সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, লোকসাহিত্যবিদ মজহারুল ইসলাম, লেখক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আ.ফ.ম কামালউদ্দিন, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস, আলাউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান প্রমুখ। এছাড়াও রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. দানিউল হক এখানকার শিক্ষক ছিলেন।

প্রত্নতত্ত্বের রত্নে জাহাঙ্গীরনগর:

এ.কে.এম শাহনাওয়াজ: দেশবরেণ্য প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ (অধ্যাপক ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজ), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে যথাক্রমে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে ফারসি ভাষায় সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন ১৯৮৫ সালে। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি অর্জন করেন ১৯৯৪ সালে। সত্তর ও আশির দশকে ‘শাহনাজ কালাম’ লেখক নামে ছড়া ও গল্প লিখিয়ে হিসেবে পরিচিত হলেও পেশা জীবনে এসে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠক্রমভিত্তিক গ্রন্থ রচনা এবং শিল্প-সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক গ্ৰন্থ ও প্ৰবন্ধ লেখায় বিশেষ মনোনিবেশ করেন। ড. এ.কে.এম শাহনাওয়াজ রচিত ও সম্পাদনাকৃত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক কলাম লিখে আসছেন তিনি।

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান: উয়ারী-বটেশ্বর খননে নেতৃত্ব দেওয়া বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ (অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান) বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা নরসিংদীর বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর নামের দুটি গ্রামব্যাপী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কার করে। ধারণা করা হয় এটি মাটির নিচে অবস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গ-নগরী ছিল।

২০২০ সালে অধ্যাপক ড. সুফি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়ামসের বাংলাদেশের জাতীয় কমিটির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে ঢাকা পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়ে ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য আবিষ্কারে ভূমিকা পালন করেন। তিনি উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর জাদুঘরসহ গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন জাদুঘর, বৌদ্ধ পদ্ম-মন্দির প্রত্নস্থান জাদুঘর, বিক্রমপুরী প্রত্নস্থান জাদুঘর এবং বিক্রমপুর জাদুঘরের প্রধান গবেষক। কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

মাসউদ ইমরান: অধ্যাপক ড. মাসউদ ইমরান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের বোঝাপড়া, জি.আই.এস টেকনোলজির মাধ্যমে ভূমির বিন্যাসের সাথে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সম্পর্কের বোঝাপড়া নির্মাণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধুনিকায়ন ও সংরক্ষন এবং ত্রি-মাত্রিক মডেল নির্মাণ ও গবেষণার মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহের সংরক্ষণ তার গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয়। পাশাপাশি শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ‘কলা ও মানবিকী অনুষদ’ এর সম্মিলিত সব বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৩ সালে (ড. সুরত আলী খান স্বর্ণপদক ও শরফুদ্দীন স্বর্ণপদক) লাভ করেন।

গৌরবের জাহাঙ্গীরনগর:

মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিভাগের অধীনে উয়ারী বটেশ্বরে খননকার্য চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা এখান থেকে এম.ফিল ও পি.এইচ.ডি গবেষণা করতে পারে। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।

বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ আবাসিক। মোট ২২ টি আবাসিক হল চালু আছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোন না কোন হলে আবাসিকের ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার খুবই সমৃদ্ধ। গ্রন্থাগারটিতে প্রায় লক্ষাধিক বই আছে। তাছাড়া গ্রন্থাগারসহ প্রায় প্রতিটি ভবনে রয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খাতে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। সেলিম আল দীন, হুমায়ুন ফরিদী, শহিদুজ্জামান সেলিম, সুমাইয়া শিমু, জাকিয়া বারি মম, আফসানা আরা বিন্দু, মিম মানতাশা সহ উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পদচারণায় মুখর হয়েছে সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত এ ক্যাম্পাস।

এছাড়াও দেশে-বিদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের (রসায়ন বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং) শিক্ষার্থীদের সাফল্য ও অর্জন উল্লেখ করার মতো, যারা দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন, এবং তাদের সাফল্য এখনও চলমান।

সাংস্কৃতিক রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর:

বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির লেক। শীতের মৌসুমে প্রচুর অতিথি পাখি এখানে আসে। অতিথি পাখিদের শুভেচ্ছা জানাতে লেকগুলোতে হাজারও শাপলার সমারোহ হয়। তারই মধ্যে পাখিদের উড়াউড়ি আর জলকলির দৃশ্য মুগ্ধ করে দেশি-বিদেশি দর্শণার্থীদের। তাছাড়া ষড় ঋতুর এদেশে ঋতু পরিবর্তনে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সকলকে আকৃষ্ট করে। প্রজাপতির সংরক্ষন ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ‘প্রজাপতি পার্ক’। প্রতিবছর বিভিন্ন আয়াজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রজাপতি মেলা’।

প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। বছরব্যাপী নাটক, বিতর্ক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীতানুষ্ঠান সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হতেই থাকে। যারফলে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন। আর সংস্কৃতি চর্চাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ’। বিকেলে মুক্তমঞ্চ, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া চত্বর, টারজান পয়েন্ট, শহীদ মিনার, অমর একুশের পাদদেশ সহ প্রভৃতি স্থানে জমে উঠে আড্ডা ও গানের আসর।

শুধু লেখাপড়া আর আড্ডার মধ্য সীমাবদ্ধ নয় খেলাধুলাতেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে একক আধিপত্য। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য মুশফিকুর রহিম এবং সবচেয়ে সফল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, ফিফা রেফারি জয়া চাকমা এখানকারই শিক্ষার্থী ছিলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে রয়েছে বিখ্যাত স্থপতি হামিদুজ্জামান খানের নকশায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। আর প্রধান ফটকের একটু সামনেই রয়েছে ‘অমর একুশ’ ভাস্কর্য। এছাড়া নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নামে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন মুক্তমঞ্চ।

দর্শনীয় কিছু স্থান:

সুইজারল্যান্ড: নাম শুনে ভাবছেন জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে আলোচনায় সুইজারল্যান্ডকে কেন আনা হচ্ছে? আপনাদের আর একটু অবাক করে দিয়ে বলতে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আছে এক টুকরো সুইজারল্যান্ড। শিক্ষার্থীরা হয়তো সুইজারল্যান্ডের সাথে স্থানটির মিল খুঁজে পেয়েছেন। তা না হলে এত এত নাম থাকতে সুইজারল্যান্ড নাম রাখবেন কেন। কে বা কারা নাম দিয়েছে তা জানা যায়নি। তবে যে বা যারা দিক, নামের স্বার্থকতা রেখেই আপনাকে মুগ্ধ করতে প্রস্তুত সুইজারল্যান্ড। এই জায়গাটির অবস্থান মওলানা ভাসানী হলের দক্ষিণ পাশে। সড়ক ছেড়ে এই জায়গায় প্রবেশ করলে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। সবুজ ঘাসের চাঁদরে ঢাকা উঁচু-নিচুঁ ভূখণ্ডটি দেখতে অনেকটা সুইজারল্যান্ডের গো-চারণ ভূমির মতো। এর তিন দিকে লেক। লেকের পাশে গাছের সারি স্থানটিকে একেক ঋতুতে দেয় একেক রূপ।

ময়না দ্বীপ: মানিক বন্দোপাধ্যয়ের বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝিতে হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? চারিদিকে শুনশান নিরবতা। জন মানবের চিহ্ন নেই। যেখানে বসতি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন হোসেন মিয়া। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এরকম জনবসতিহীন কোনও দ্বীপের সন্ধান পেয়েছেন? সম্ভবত পেয়েছেন। তা না হলে বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন লেকের অপর পাড়ের গাছপালা বেষ্টিত দ্বীপের মতো স্থানটিকে তারা ময়না দ্বীপ বলবেন কেন। কে বা কারা নামটি দিয়েছেন তা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা যায়, যখন নামটির সূচনা হয়েছিল তখন স্থানটিতে কোনও বসতি ছিল না।

টারজান পয়েন্ট: ‘টারজান অফ দ্য এইপস’ উপন্যাসের আলোচিত চরিত্র টারজানের কথা মনে আছে? পূর্ব আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে জন্মের পর বন্য প্রাণীরা যাকে বড় করে তোলে। কাল্পনিক এই চরিত্রটির কথা হয়তো আপনাদের কারো অজানা নয়। অনেকেই টারজানকে নিয়ে নির্মিত অনেক সিনেমাও দেখে থাকবেন। চলুন না কাল্পনিক এই চরিত্রটি নিয়ে আমরাও একটু কল্পনায় হারাই। ধরুন, টারজান জাহাঙ্গীরনগরে আসলেন। এসে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের পূর্ব পাশের একটি দোকানে গিয়ে ক্যাম্পাসের কাঁচা আম দিয়ে তৈরি শরবত খেয়ে আবার পূর্ব আফ্রিকায় ফিরে গেলেন, তারপর শিক্ষার্থীরা টারজানের আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানটির নাম দিলেন ‘টারজান পয়েন্ট’। কী? অদ্ভূত লাগছে তাই না?

আসলে বাস্তবে এমনটা না ঘটলেও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের পূর্ব পাশে ঘন জঙ্গল আচ্ছাদিত একটি স্থানকে ‘টারজান পয়েন্ট’ নামকরণ করা হয়েছে। কেন এমন নামকরণ করা হয়েছে তা অবশ্য জানা নেই। তবে স্থানটির দুই পাশ ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। কে জানে এমন ঘন জঙ্গলের কারণে হয়তো টারজানকে কল্পনা করে শিক্ষার্থীরা এটাকে টারজান পয়েন্ট নাম দিয়েছেন।

মুরগি চত্বর: ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এই ধাঁধার সমাধান বিজ্ঞ জনেরা আজও দিতে পারেননি। এই ধাঁধার মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস আর বাস আগে নাকি ক্যাম্পাস আগে সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ৫ বছর কাটিয়ে দেন, তবু ধাঁধার উত্তর মেলাতে পারেন না। তাদের এই ‘কনফিউজড’ মুখের দিকে তাকালে কি মুরগির অস্তিত্ব খুঁজে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীরা? সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো তারাই ভালো দিতে পারবেন। আমরা বরং সে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে পাঠকদেরকে জায়গাটির অবস্থান জানিয়ে দিই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের পশ্চিম দিকের একটি জায়গার নাম মুরগি চত্বর। যেখান থেকে ঢাকাগামী শিক্ষার্থীদের জন্য বাস ছেড়ে যায়। বাকিটা আপনারাই বুঝে নিন।

রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় উঁচু-নিচু পাহাড় আর সবুজ বৃক্ষের সাথে সাদা মেঘের মিতালী। যেখানে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে গেছে স্বচ্ছ জল ধারা। এমন দৃশ্য যেকোন প্রকৃতি প্রেমীকে আকৃষ্ট করবে। তবে এমন উঁচু-নিচুঁ পাহাড় না থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এক খণ্ড রাঙ্গামাটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক বরাবর উত্তর দিকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি স্কুল এন্ড কলেজ পেরোলেই চোখে পড়বে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত লাল মাটির ভূখণ্ড। ক্যাম্পাসবাসীরা এটাকেই রাঙ্গামাটি নামে ডেকে থাকেন।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে লন্ডন ব্রিজ, মনপুরা দ্বীপ, বৃন্দাবন, লাভ ল্যান্ড প্রভৃতি স্থানের বিচিত্র সব নাম রয়েছে। তবে এসব নামের কোন দাপ্তরিক ভিত্তি নেই। আর কে বা কারা, কখন এসব স্থানের নামকরণ করেছেন সে সম্পর্কেও তেমন কোন তথ্য জানা যায় না। পাশাপাশি সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়া ও সেলিম বল দীন মুক্তমঞ্ছ ও আছে এই তালিকায়।

আন্দোলন-সংগ্রামে জাহাঙ্গীরনগর:

বিভিন্ন জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করেন। এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনেও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত হয়। পুনরায় প্রত্যাবর্তন করলে ১৯৯৯ সালে শিক্ষার্থীদের এক অভ্যুত্থানে ওই অভিযুক্তরা পুনরায় বিতাড়িত হয়। এই আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন হিসেবেও পরিচিত।

সফলতার মাঝে সীমাবদ্ধতা:

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও বিগত ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে তীব্র সিট সঙ্কট থাকলেও, এখন অনেকটাই কমে এসেছে হলগুলোতে। সর্বশেষ ৫৩ তম ব্যাচই (শিক্ষাবর্ষ ২০২৩-২৪) সম্ভবত একমাত্র ব্যাচ, যাদের সবাই ক্লাস শুরুর আগেই নিজের জন্য বরাদ্দকৃত হলের সিট বুঝে পেয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে আরো কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে, সময়োপযোগী অনেক বিভাগ এখনও চালু হয়নি।

আধুনিকতার সম্পূর্ণ ছোঁয়া পায়নি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী। দীর্ঘ প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় পরে, গত ডিসেম্বরে (কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ – জাকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে তার দৃষ্টান্ত রেখে আসছে। জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, যুগ যগ ধরে এই ধারা অব্যাহত থাকুক, এটাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কামনা।

 ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।