
সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রা যেমন বদলেছে, তেমনি পরিবর্তিত হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি চর্চাও। বছরের দুই ঈদ – ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব, যা আনন্দ, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। কিন্তু বর্তমান যুগে এই পবিত্র উৎসবেও অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছায়া প্রবেশ করেছে। হারিয়ে যাচ্ছে একসময়কার প্রাণবন্ত ঈদ আমেজ এবং আনন্দ ভাগাভাগির হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত। বিশেষ করে উঠতি বয়সী যুবকদের মধ্যে অসুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্যণীয়। কিশোর-যুবকেরা ডিভাইস নির্ভর হয়ে পড়েছে, যার ফলে সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে নেশাজাত দ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। অন্যদিকে, ঈদ উদযাপনের নামে তরুণদের একাংশ পিকআপ বা গাড়িতে উচ্চশব্দের ডিজে গান বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে, যা ইসলামিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পরিপন্থী।
সুস্থ সংস্কৃতির পথে ধনুয়াইশের ব্যতিক্রমী আয়োজন
এই অপসংস্কৃতির থাবা থেকে যুবসমাজকে রক্ষার লক্ষ্যে কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার ধনুয়াইশ গ্রামে আয়োজিত হলো ঈদ পুনর্মিলনী ২০২৫। গ্রামের যুবসমাজ ও প্রবাসীদের সম্মিলিত উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়। মূলত যুবসমাজকে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার প্রতি আগ্রহী করতে এবং অপসংস্কৃতি ও বিপথগামিতা থেকে ফেরাতে গ্রামবাসীরা এই আয়োজনকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেন।
এর আগে, ২১ মার্চ গ্রামের চিকিৎসা সেবক আবু সায়মনের নেতৃত্বে যুবসমাজকে একত্রিত করে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভার আলোচনার ভিত্তিতে অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য ১৫ সদস্যের একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। এরপর, ২৩ মার্চ গ্রামের মাদ্রাসা কক্ষে এক জরুরি বৈঠকে অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয় এবং কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।
ঈদের দিন পুনর্মিলনীর আয়োজন
ঈদের দিন সকাল ৯টার মধ্যে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করেন। সকাল ১০টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে এবং গ্রামের সর্দার ওয়াদুদ মাস্টারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
শিশু-কিশোরদের জন্য জ্ঞান ও মেধা প্রতিযোগিতা
শুরুর অংশে ৩৭তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার মোজাম্মেল হাসান ও ড. মো. মহিবুল্লাহর নেতৃত্বে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিত ও সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক ইমন পরীক্ষার হল সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ১ম, ২য় এবং ৩য় স্থান অর্জনকারীদের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।
এরপর পর্যায়ক্রমে ছোটদের জন্য অঙ্ক দৌড়, বিস্কিট প্রতিযোগিতা, মার্বেল প্রতিযোগিতা ও হামদ-নাতের ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। শিশুদের জন্য আয়োজিত এসব প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মকে সুস্থ বিনোদনের প্রতি আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে। দুপুর ১টায় বিরতির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব শেষ হয়।
যুবকদের অংশগ্রহণে জমজমাট খেলা ও প্রতিযোগিতা
বিরতির পর শুরু হয় অনুষ্ঠানের প্রধান অংশ। প্রথমেই যুবক-বয়স্কদের জন্য হাড়িভাঙা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। হাড়িভাঙায় উত্তীর্ণ প্রতিযোগীদের নির্ধারণের পর শুরু হয় বিবাহিত-অবিবাহিতদের রশিটান প্রতিযোগিতা। এই ইভেন্টটি ছিল পুরো অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। দর্শকদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত রশিটান প্রতিযোগিতায় অবশেষে বিবাহিত যুবকরা জয়লাভ করে। এরপর ফুটবলের পেনাল্টি কিক প্রতিযোগিতা ও অন্যান্য ইভেন্ট সম্পন্ন হয়। প্রতিটি ইভেন্টে উত্তীর্ণ প্রতিযোগীদের বাছাই করা হয় পুরস্কারের জন্য।
সম্মাননা ও পুরস্কার বিতরণ
দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তিতে শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এই পর্বের প্রথমেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা এবং প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। এরপর প্রতিটি ইভেন্টের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হলে তারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তাদের মুখের আনন্দ-তৃপ্তির হাসি যেন অনির্বাণ প্রদীপের মতো দীপ্তি ছড়ায়। এরপর র্যাফেল ড্রয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি ঘটে। অংশগ্রহণকারী প্রতিটি প্রতিযোগীকে সাধারণ পুরস্কার দেওয়া হয়, যা অনুষ্ঠানের উদার ও উৎসাহব্যঞ্জক দিককে তুলে ধরে।
সুস্থ সংস্কৃতির গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ উদ্যোগ
ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য আনন্দ ও উৎসবের দিন। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা আমাদের সমাজকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে তোলে। ঈদের মূল বার্তা শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আমরা অশ্লীলতা ও অনৈতিক কার্যকলাপ এড়িয়ে সত্যিকারের আনন্দ উপভোগ করতে পারি।
সুস্থ সংস্কৃতির মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। তারা যেন ক্ষতিকর বিনোদন বা অপসংস্কৃতির দিকে না যায়, সেজন্য এমন শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা অত্যন্ত জরুরি। ধনুয়াইশ গ্রাম গতবারের মতো এবারও এমন একটি আয়োজনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা ও সুনাম অর্জন করেছে।
পরিশেষে, ঈদ শুধুমাত্র ভোগ-বিলাসের উৎসব নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, মানবপ্রেম ও নৈতিকতা চর্চার একটি অনন্য উপলক্ষ। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার উদ্যোগ আরও ব্যাপক পরিসরে গ্রহণ করা উচিত, যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। ধনুয়াইশ গ্রাম একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অন্যান্য গ্রাম ও শহরগুলোর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ওমর ফারুক ইমন
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।