মে ১২, ২০২৫

সোমবার ১২ মে, ২০২৫

কুমিল্লা: ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল – ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর

ঐতিহাসিকভাবে কুমিল্লা "ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর" হিসেবে সুপরিচিত। এই বিশেষণের পেছনে রয়েছে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। পাশাপাশি, কুমিল্লার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ঐতিহাসিক পুকুর ও জলাধার (স্থানীয়ভাবে 'দিঘী' নামে পরিচিত) এখানকার জীবনযাত্রা এবং ঐতিহ্যকে এক স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে। আসুন ব্যাংকের প্রেক্ষাপট এবং জলাধারের তাৎপর্য জানা যা।
কুমিল্লা: ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল - ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর/ছবি: রাইজিং কুমিল্লা/শাদমান আল আরবী

ঐতিহাসিকভাবে কুমিল্লা “ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর” হিসেবে সুপরিচিত। এই বিশেষণের পেছনে রয়েছে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। পাশাপাশি, কুমিল্লার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ঐতিহাসিক পুকুর ও জলাধার (স্থানীয়ভাবে ‘দিঘী’ নামে পরিচিত) এখানকার জীবনযাত্রা এবং ঐতিহ্যকে এক স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে। আসুন ব্যাংকের প্রেক্ষাপট এবং জলাধারের তাৎপর্য জানা যা।

ব্যাংক (আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপট):

উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের শুরুটা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে, বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় উদ্যোগে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে।

কুমিল্লা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের জন্ম হয়েছিল, যা কেবল স্থানীয় অর্থনীতিতেই নয়, বৃহত্তর পরিসরেও প্রভাব ফেলেছিল।

কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশন / পুবালী ব্যাংক: ১৯১৪ সালে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি কুমিল্লার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি স্থানীয় পুঁজি এবং উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি সফল ব্যাংক ছিল। পরবর্তীতে, এটি “পুবালী ব্যাংক” নামে জাতীয় পর্যায়ে একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিণত হয় এবং এর প্রধান কার্যালয় দীর্ঘদিন কুমিল্লায় অবস্থিত ছিল।

পুবালী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার কুমিল্লার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছিল। এটি স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক: ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটিও কুমিল্লার অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছিল। স্থানীয় কৃষিজীবী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের আর্থিক চাহিদা পূরণে এই ব্যাংক সহায়ক ছিল।

নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক: ১৯৩২ সালে কুমিল্লায় এই ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটিও স্থানীয় অর্থনীতিতে পুঁজি সরবরাহ এবং আর্থিক লেনদেনকে সহজতর করতে সাহায্য করেছিল।

এই ব্যাংকগুলো কেবল অর্থ জমা রাখা বা ঋণ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এরা সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝুঁকি কমানো এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার

ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কুমিল্লার মানুষের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছিল এবং এটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সহায়ক হয়েছিল। এই কারণে, কুমিল্লাকে একটি “ব্যাংক সমৃদ্ধ” অঞ্চল হিসেবে দেখা হতো।

ট্যাংক (ঐতিহাসিক জলাধারের তাৎপর্য):

কুমিল্লার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অসংখ্য জলাধার বা দিঘী তৈরি হয়েছে। এই দিঘীগুলো কেবল পানির উৎস ছিল না, বরং এদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম।

ধর্মসাগর দিঘী: ১৪৫৮ সালে ত্রিপুরার মহারাজা ধর্ম মানিক্য এই বিশাল দিঘীটি খনন করেছিলেন। এর আয়তন প্রায় ২৩.১৮ একর। জনশ্রুতি আছে, রাজা প্রজাদের জলের কষ্ট নিবারণের জন্য এটি খনন করেছিলেন। ধর্মসাগর দিঘী কুমিল্লার একটি ঐতিহাসিক প্রতীক এবং এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এর সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য আজও বহু মানুষকে আকর্ষণ করে।

রাণীর দিঘী: এই দিঘীটিও কুমিল্লার একটি উল্লেখযোগ্য জলাধার। এর নামকরণ সম্ভবত কোনো রাণীর নামে হয়েছিল। এটিও স্থানীয় মানুষের জল ব্যবহারের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখত।

উজীর দিঘী: উজীর দিঘীও কুমিল্লার পুরোনো দিঘীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্থানীয় লোককথায় আজও প্রচলিত।

নানুয়ার দিঘী: এই দিঘীটিও কুমিল্লার গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই দিঘীগুলো কেবল পানির উৎস ছিল না। এগুলো সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দিঘীর পাড়ে মানুষের সমাগম হতো।

এছাড়া, এই দিঘীগুলো কুমিল্লার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই জলাধারগুলো কুমিল্লার প্রাচীন সভ্যতা এবং জনজীবনের প্রতিচ্ছবি বহন করে।

“ব্যাংক ও ট্যাংক”-এর সমন্বয়:

কুমিল্লাকে “ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর” বলার কারণ হলো এই দুটি স্বতন্ত্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের পরিচয় বহন করেছে। একদিকে যেমন এখানে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল এবং বহু ব্যাংক স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি অন্যদিকে অসংখ্য ঐতিহাসিক জলাধার কুমিল্লার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনজীবনের সুবিধা এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য বৃদ্ধি করেছে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে কুমিল্লা একটি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কুমিল্লার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাংক এবং জলাধার উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ব্যাংক যেমন আর্থিক সমৃদ্ধি এনেছিল, তেমনি দিঘীগুলো জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

এই কারণেই কুমিল্লা ঐতিহ্যগতভাবে “ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর” নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

 

মোঃ আল-আমিন
ব্যাংকার, এমবিএ (হিসাব বিজ্ঞান)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন