কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়ের এক গহিন এলাকা নাম বড় ধর্মপুর। একসময় বড় ধর্মপুর এলাকায় যেতে কোন সড়ক ছিল না। ২০১৬ সালে সেখানের নির্জন জঙ্গলে গড়ে উঠে একটি স্কুল। নাম মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল।
স্থানীয়রা এটিকে জাপানি স্কুল বললেও এর ৪০ ভাগ ব্যয় বহন করেন তারিক-উল-ইসলাম মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী নাহিদা আক্তার। বাকিটা তাঁদের জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক তোশিকো অনিশিসহ তাঁর বন্ধুরা বহন করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার রতনপুর বাজার। বাজারটি মহাসড়ক লাগোয়া। বাজার থেকে তিন কিলোটার সামনে পাহাড়ি পথে বড় ধর্মপুর। অটোরিকশায় চড়ে যাওয়া যায় জাপানি স্কুলে।
মূল সড়ক থেকে নেমে পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে প্রবেশ করতে হবে স্কুল আঙিনায়। হাঁটতে গিয়ে কানে বাজবে নানা প্রজাতির পাখির শব্দ। তিন তলা ভবন। স্কুলে প্রবেশ করতেই প্রধান ফটকে চোখে পড়বে জাপানি, ইংরেজি ও বাংলায় লেখা স্কুলের নাম।
স্কুলের ওপরে উড়ছে বাংলাদেশি ও জাপানি পতাকা। চেয়ার-টেবিল লাল-সবুজ ও সাদা রঙের। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী ১০০ জন। জামা, জুতা, বই-খাতা, দুপুরের খাবার স্কুল বহন করে।
শিক্ষার্থীদের পরনে সবুজ প্যান্ট ও সাদা জামা। খাবার সময়ে সবাই লাইন ধরে হাত ধুতে যায় বেসিনে। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে ক্লাসে বসে খায়।
স্কুলটির বিশেষত্ব হলো, পড়ালেখার জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না শিক্ষার্থীদের। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয় স্কুলটিতে। প্রতি শ্রেণিতে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। সবার জন্য রয়েছে দুপুরে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা। স্কুল থেকে শিশুদের জন্য জামাকাপড়, ক্রীড়া সরঞ্জাম, বই ও শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
মেনে চলা হয় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি। স্কুলটির বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হতদরিদ্র পরিবারের। এদের কারো মা নেই, কারো বাবা নেই। কারো কারো পরিবারে বিচ্ছেদ। কুড়িয়ে পাওয়া শিক্ষার্থীও আছে এ স্কুলে। ঘরে ঠাঁই না পেয়ে বারান্দায় ঘুমানো শিশু এখানে আছে। আছে এখনও বিদ্যুতের আওতায় না আসা পরিবারের শিশুও।
বাংলাদেশের অগ্রসর জনপদ কুমিল্লার উল্টো প্রতিচ্ছবিই যেন ভেসে ওঠে এই জনপদে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক লাভলী আক্তার বলেন, রতনপুর থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তা ছিল। এরপর এক কিলোমিটার পথ জঙ্গল মাড়িয়ে আসতে হতো। সাপ-বিচ্ছুর ভয় ছিল। এদিকে বাচ্চাগুলোর অভিভাবকরা সন্তানদের পড়ালেখার মর্ম অনুভব করতে পারতেন না। কারো করো তো অভিভাবকই নেই। যাদের অভিভাবক আছে, তাদের বিত্ত নেই। চারপাশে ঝোপজঙ্গল।
মনে হতো এ জনপদে স্কুল পরিচালনা দুরূহ হবে। আমরা অনেকগুলো ক্যাম্পেইন করি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাই। স্থানীয়রা ভালো সাড়া দেন। তাছাড়া এমন সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে তারা বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
স্কুল প্রতিষ্ঠার দুই-তিন বছর পর এখানে রাস্তাঘাট উন্নত হতে শুরু করে। আলোকিত হয়ে ওঠে এই জনপদ। তিনি জানান, জাপানিরা বছরে দুইবার স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন। স্কুলটির অগ্রগতি নিয়ে তারা সন্তুষ্ট।
স্কুলটির উদ্যোক্তা তারিক-উল-ইসলাম মজুমদার বলেন, একবার জাপানের কিছু বন্ধু কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন। বেড়াতে এসে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের অনেক ভিক্ষুককে সহায়তা করতে থাকেন তারা। আমি এটা দেখে তাদের নিরুৎসাহিত করি। অনুরোধ করি, এভাবে দান না করে বাংলাদেশে স্থায়ী কিছু করার ব্যাপারে ভাবার জন্য।
মুহূর্তে লালমাই পাহাড় এলাকায় আমার দাদার বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ওই এলাকার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় না। আশেপাশে স্কুল নেই। ওখানে একটা স্কুল করার জন্য বন্ধু তোশিকো অনিশিসহ অন্যদের প্রস্তাব করি। কিন্তু সরাসরি তারা এ প্রস্তাবে সাড়া দেয় না।
কিছুদিন পর তারা আমাকে জাপান যেতে বলে। ভাবলাম অন্য কোনো দরকারে যেতে বলেছে। গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড! তারা স্কুল করার ব্যাপারে সদয় হয়েছেন। এ নিয়ে সবাই মিলে মিটিং করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
এরপর সবার আন্তরিকতায় এ গহীন জনপদে তিনতলা ভবন বিশিষ্ট স্কুলটি গড়ে তুলি। বর্তমানে সাতজন শিক্ষক আছেন স্কুলটিতে।
এ উদোক্তা আরো জানান, এ এলাকায় একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান করার জন্য জাপানি বন্ধুদের প্রস্তাব করেছি। যেখানে তিনবছর মেয়াদি কোর্স থাকবে। প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও জাপানি ভাষা শেখানো হবে। পাশাপাশি কর্মমুখী কোর্স থাকবে। এখান থেকে দক্ষ জনশক্তি হয়ে জাপানসহ বাইরের রাষ্ট্রে কাজ করবে আমাদের সন্তানেরা।
আমার বন্ধুরা এতে ভালো সাড়া দিয়েছেন। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের কাজে হাত দিতে পারবো।
তিনি বলেন, কাজটি হাতে নেওয়ার পর মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। অনেকে বলতে শুরু করলেন আমি পাগলামি করছি।
সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ বলেন, ইতিবাচক মানুষদের দ্বারা সমাজ পরিবর্তন হয়। তারিক-উল-ইসলাম মজুমদার এমনই একজন ব্যক্তি। উপজেলা প্রশাসন স্কুলটির পাশে আছে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছে।
কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল মান্নান বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জেনেছি। সমাজে এমন কাজ প্রশংসনীয়। আমি এ স্কুলটি পরিদর্শনে যাবো।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC