কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের পণ্যসামগ্রী বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। এখানকার কারিগরদের নিপুণ হাতের তৈরি প্রায় ৩ হাজার রকমের মাটির পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে আসছে। সেখানে তৈরি হওয়া নান্দনিক টেরাকোটার ‘মাটির টাইলস’ এর চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন দেশের বায়াররা দেশি কোম্পানির মাধ্যমে ডিজাইন পাঠান। টেরাকোটা তৈরির জন্য এটেল মাটির সঙ্গে দোআঁশ মাটি মিশিয়ে নিতে হয়। মাটি দিয়ে তৈরি ফর্মায় ডিজাইন বসিয়ে শুরু হয় টেরাকোটা তৈরি। রোদে কিছুটা শুকানোর পর এগুলো আগুনে পোড়ানো হয়।
মাটির গায়ে ফুটে উঠা এসব টেরাকোটা বা ‘মাটির টাইলস’ যাচ্ছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এতে টেরাকোটার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। মৃৎশিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতির কর্মকর্তা ও মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
টেরাকোটা তৈরির কারিগর শ্যামলা রাণী শর্মা জানান, অতি সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি টেরাকোটা তৈরি করতে হয়। একটি নির্দিষ্ট ডিজাইনের হলে একদিনে অন্তত ২০টি টেরাকোটা তৈরি করা সম্ভব হয়। ডিজাইন ভিন্ন হলে সময় লাগে, দৈনিক তৈরির সংখ্যাটাও কম হয়। রুদ্রপাল সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক বিপ্লব চন্দ্র পাল জানান, ২০১২ সালের এপ্রিলে এক ব্যক্তি মাটির তৈজসপত্র কিনতে সমিতির কারখানায় আসেন এবং বেশ কিছু মাটির তৈরি পণ্য কিনেন। এ সময় তিনি মাটি দিয়ে টেরাকোটা বা টাইলস তৈরি করে দিতে কারখানায় ডিজাইন সরবরাহ করেন। সেই থেকে পথ চলা শুরু।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রাচীন যুগে রাজা-বাদশাহর বাড়ির ভেতর-বাইরে লাগানো টেরাকোটার আদলে বিজয়পুরেও টেরাকোটা বা মাটির টাইলস তৈরি হচ্ছে। বাড়ির দেওয়ালে বসানো টেরাকোটায় প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই দেশ-বিদেশের ধনাঢ্য ও শৌখিন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা তাদের বিলাসবহুল বাড়িতে এসব টেরাকোটা বা টাইলস ব্যবহার করেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিজয়পুরের তৈরি এসব টেরাকোটার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা বাংলাদেশি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে ডিজাইন প্রেরণ করেন। তাদের চাহিদা অনুযায়ী টেরাকোটা তৈরি করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির হিসাবরক্ষক রাজেশ চক্রবর্তী জানান, বায়ারদের পছন্দমতো ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে উৎপাদিত প্রতিটি টাইলস ৫০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। আমাদের ডিজাইন হলে দাম কিছুটা কম হয়। রাজেশ চক্রবর্তী আরো জানান, বিজয়পুরের মৃশিল্পের ঐতিহ্য কয়েকশ বছরের। একসময় দক্ষিণ ও উত্তর বিজয়পুর, তেগুরিয়াপাড়া, গাংকুল, বারপাড়া, নোয়াপাড়া ও দুর্গাপুরসহ সাতটি গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের সাত শতাধিক পরিবারের মানুষ মৃৎপণ্য তৈরি করত।
বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস কুমার পাল জানান, মৃৎশিল্প রক্ষার জন্য সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত ব্যক্তিত্ব ড. আখতার হামিদ খানের অনুপ্রেরণায় ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল ‘বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি’ গঠিত হয়। তিনি জানান, এখানকার পণ্য জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, লন্ডন, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, হল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশিস ঘোষ বলেন, বিজয়পুরের মৃৎশিল্প কারখানা পরিদর্শন করেছি। এর ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। সেখানে মাটির তৈরি শো-পিসসহ বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে মাটির টাইলসও (টেরাকোটা) তৈরি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, জীবনমান ও জীবিকার প্রয়োজনে ধীরে ধীরে অনেকে পেশা বদল করেছে। বর্তমানে মৃৎশিল্পে কাজ করছে ঐ সাতটি গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার। তবে মাটির টাইলস বা টেরাকোটা তৈরি হচ্ছে শুধু রুদ্রপাল সমবায় সমিতির অধীন পরিচালিত একটি কারখানায়।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC