
এবারের পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় রাজধানীর আকাশ সেজেছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত ব্যতিক্রমী ড্রোন শো হাজার হাজার দর্শকের মন জয় করে নিয়েছে। প্রযুক্তির আধুনিক স্পর্শে নববর্ষের উদযাপন যেন নতুন এক মাত্রা পেল।
সন্ধ্যা নামতেই রঙিন আলোয় ভরে ওঠে রাজধানী ঢাকার আকাশ। শত শত ড্রোনের সমন্বয়ে তৈরি হয় মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন প্রতীক ও বার্তা। তবে দর্শকদের বিশেষভাবে আলোড়িত করে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। একইসঙ্গে, ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রদর্শিত দৃশ্যটিও উপস্থিত সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ড্রোন শোয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। এই অত্যাধুনিক প্রদর্শনী কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলও কম নয়। এবারের বৈশাখী ড্রোন শো সেই আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কী এই ড্রোন শো?
ড্রোন শো হলো আকাশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আলো ঝলমলে নকশা তৈরি করার একটি অত্যাধুনিক কৌশল। এখানে একদল সুসংগঠিত ড্রোন একটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই সফটওয়্যার প্রতিটি ড্রোনের গতিবিধি ও আলোর পরিবর্তন নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করে। এরপর ড্রোনগুলো একসঙ্গে উড়ে গিয়ে আকাশে বিভিন্ন আকর্ষণীয় চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
জানা যায়, ২০১২ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রদর্শনী ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। পরবর্তীতে ইন্টেল কর্পোরেশন সুপার বোল হাফটাইম শো এবং শীতকালীন অলিম্পিকের মতো বড় ইভেন্টে ড্রোন শো আয়োজন করে বিশ্বব্যাপী এই ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে।
কীভাবে কাজ করে এই আলোর খেলা?
একটি ড্রোন শো পরিচালনার জন্য প্রথমে একটি সুনির্দিষ্ট ডিজাইন তৈরি করা হয়। এই ডিজাইনে বিভিন্ন ছবি ও আলোর ইফেক্ট এর সময়কাল নির্ধারণ করা থাকে। এরপর একটি বিশেষ সফটওয়্যার সেই স্থির চিত্রগুলোতে অ্যানিমেশন যোগ করে, যা ড্রোনগুলোর গতিপথ নির্ধারণ করে।
এই ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার সঙ্গে একটি উপযুক্ত সাউন্ডট্র্যাকও যুক্ত করা হয়। এরপর পুরো শো-এর তথ্য রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে প্রতিটি ড্রোনে পাঠানো হয়। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে, ড্রোনগুলো আকাশে উড়ে গিয়ে পূর্বনির্ধারিত নকশা তৈরি করতে শুরু করে।
একটি আকর্ষণীয় ড্রোন শোয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ পরিকল্পনার প্রয়োজন। ভার্জ অ্যারোর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে ড্রোন শো-এর জন্য ড্রোন ও সফটওয়্যার তৈরি করে। এই ড্রোনগুলোতে ক্যামেরা না থাকলেও অত্যন্ত উজ্জ্বল এলইডি লাইট লাগানো থাকে, যা আকাশে স্পষ্ট ও সুন্দর ছবি তৈরি করতে পারে।
ড্রোন শো পরিচালনা করেন প্রশিক্ষিত এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত পাইলটরা। তারা আকাশপথের নিয়মকানুন এবং আবহাওয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত থাকেন। প্রতিটি শো শুরুর আগে একটি চেকলিস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে সব ড্রোন সঠিকভাবে কাজ করছে, ব্যাটারিতে পর্যাপ্ত চার্জ আছে এবং আকাশসীমা নিরাপদ আছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে পাইলট কেবল একটি ‘গো’ বোতাম চাপেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই ড্রোনগুলো আকাশে আলোর নকশা আঁকতে শুরু করে। ড্রোনগুলো জিপিএস এবং অন্যান্য সেন্সরের সাহায্যে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে এবং একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে।
ঢাকার বৈশাখী ড্রোন শো-তে যা ছিল:
ঢাকার বৈশাখী ড্রোন শো শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায় এবং প্রায় ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রদর্শনীর শুরুতেই আকাশে ভেসে ওঠে শোষণ-শাসনের খাঁচা ভেঙে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পাখির ছবি। এরপর একে একে ফুটিয়ে তোলা হয় অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদ এবং উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের জল দানকারী শহীদ মীর মুগ্ধের প্রতিচ্ছবি।
এছাড়াও, ড্রোন শোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বিপ্লব ও সংগ্রামে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, সাধারণ মানুষের প্রতীক রিকশাচালক, জাতীয় ফুল শাপলা, ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জুলাই বিপ্লব এবং ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য সমবেদনা ও প্রার্থনার দৃশ্য। চীন ও বাংলাদেশের ৫০ বছরের বন্ধুত্বের প্রতীকও আকাশে ভেসে ওঠে। সবশেষে, ড্রোন আলোর মাধ্যমে ‘শুভ নববর্ষ’ লিখে দর্শকদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হয়।