মে ৪, ২০২৫

রবিবার ৪ মে, ২০২৫

এনসিপি: ফুল ফুটেছে, গন্ধ ছড়ায়নি!

এনসিপি: ফুল ফুটেছে, গন্ধ ছড়ায়নি!
এনসিপি: ফুল ফুটেছে, গন্ধ ছড়ায়নি/ছবি: সংগৃহীত

উত্তাল ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর সবচেয়ে বড় ও গভীর রাজনৈতিক ঘটনা। কেউ বলেন ‘বিপ্লব’, কেউ বলেন ‘অভ্যুত্থান’। আমি ব্যক্তিগতভাবে “গণঅভ্যুত্থান” শব্দটি ব্যবহার করলেও এ অভ্যুত্থান ‘বিপ্লবের উপসর্গে’ আক্রান্ত বলা ভুল হবে না।

সময়ের পরিক্রমায় এই ২৪-এর আন্দোলন ইতিহাসে জায়গা করে নেবে—তবে আমাদের কামনা, এমন নৃশংস দিন জাতির জীবনে যেন আর না আসে।

আজকের লেখার মূল বিষয় সেই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গঠিত একটি নতুন রাজনৈতিক দল—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ছাত্র আন্দোলনের উর্বর ভূমি থেকে উঠে আসা বিপ্লবী অগ্রনায়কদের একাংশের এই দলটি আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই আশাগুলো কতটা রূপ পাচ্ছে, তা নিয়ে আজ একটু ভাববার অবকাশ রাখে।

রাজকীয় উত্থান ও কিছু প্রশ্ন

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন জাঁকজমকপূর্ণ দলীয় আত্মপ্রকাশ আগে দেখা যায়নি। এটি নিঃসন্দেহে নজর কাড়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে—কিছুদিন আগেও যারা ছাত্রাবাসে থাকতেন, তাদের পক্ষে এত ব্যয়বহুল আয়োজন কীভাবে সম্ভব হলো? সরকারি বাসে লোক আনা, সরাসরি সম্প্রচারের আধুনিক সরঞ্জাম, আর পরে রাজকীয় ইফতার—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জন্মানো স্বাভাবিক।

রাজনীতি করতে অর্থের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। তবে নতুন রাজনৈতিক দল যদি “নতুন রাজনীতির” কথা বলে, তবে তাদের অর্থের উৎসও স্বচ্ছ হওয়া জরুরি। সেই জায়গায় এনসিপি এখনও পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

নতুন রাজনীতি কতটা নতুন?

শুধু আওয়ামী বিরোধিতা, ছাত্র-জনতার তারুণ্য—এসব দিয়ে কিছু সময় টিকে থাকা যাবে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী রাজনীতি গড়ে তুলতে হলে নিজস্ব চিন্তা, আদর্শ এবং পরিকল্পনার দরকার।

এনসিপির এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বয়ান বেশ আবছা, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অজ্ঞ।

নতুন দল মানেই আমরা আশা করি, তারা নতুন কিছুর দৃষ্টান্ত দেখাবে। কিন্তু সেই নতুনত্ব কোথায়? সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে এনসিপির কার্যক্রম সীমিত, আর সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের প্রান্তিক ভোটাররা এখনও ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’ চেনেন। সেখানে নিজস্ব প্রতীক ও ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে, মাঠে নামতে হবে, সময় দিতে হবে।

নেতৃত্বের অভাব ও পরিপক্বতার প্রশ্ন

বিরোধী শিবির এনসিপিকে ‘বাচ্চা’ দল বলে ব্যঙ্গ করে। তারা কেন করে? কারণ মাঠের রাজনীতিতে এনসিপির উপস্থিতি এখনো মলিন। দৃশ্যত সকল নেতৃত্ব কেবল তরুণদের হাতে।

একটি রাজনৈতিক দলের ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব দরকার—যেখানে প্রাজ্ঞ ও তরুণ নেতৃত্ব একসঙ্গে কাজ করে। এনসিপির ক্ষেত্রে সেটা চোখে পড়ে না।

হাসনাত আবদুল্লাহ হয়ত কিছুটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু বাকি নেতৃত্বে কেউ কেউ নিছক ‘আঁতেল’ বা ‘সেলিব্রিটি’ ভাব বজায় রাখতে বেশি আগ্রহী।

রাজনীতিতে নেতৃত্ব শুধু ক্যামেরার সামনে কথা বলা নয়—বাস্তবিক কঠিন সিদ্ধান্ত, বাস্তব বিশ্লেষণ, এবং সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের সক্ষমতা লাগে।

আদর্শের দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব

মধ্যমপন্থী হওয়ার মানে এই নয় যে, আপনি এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্ট আর লেবাসধারি হুজুরকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে যোগসূত্র করবেন।

হাস্যকরভাবে এরা উভয়ই ‘চরমপন্থা’। বরং জনগণ চায় একটি স্পষ্ট, গ্রহণযোগ্য ও নৈতিক অবস্থান।

এনসিপি যদি রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে, তবে তাদের প্রথমেই দরকার নিজের বক্তব্য ও অবস্থান স্পষ্ট করা—সংবিধান সংস্কার হবে নাকি পুনঃলিখ? রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হবে?

গঠনমূলক পথ কী হতে পারে?

প্রথমত, এনসিপিকে মাঠমুখী হতে হবে। সব কাজ শুধু অনলাইন-নির্ভর হলে চলবে না। গ্রামগঞ্জের মানুষকে বুঝতে হবে, তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে।

দ্বিতীয়ত, নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। শুধু “আমরা নতুন, তরুণ” বললে চলবে না।

তৃতীয়ত, সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত করতে হবে। গবেষণা সেল তৈরি করতে হবে, রাজনৈতিক ভাষা ও কৌশল আয়ত্ত করতে হবে।

অভিজ্ঞ, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বদের পাশে রাখতে হবে—যারা সংকটে পথ দেখাতে পারেন। চাটুকার বা সুবিধাবাদী চরিত্রগুলোকে ছেঁকে ফেলতে হবে, নয়তো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।

সময় এখনো আছে, কিন্তু অল্প

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অল্পতেই তুষ্ট, কিন্তু প্রতারিত হলে আর ফিরে তাকায় না। তারা জানে নেতারা গালগল্প শুনায়, তারপরে ও ভোট দেয় কেবল পাশে থাকার নিশ্চয়তা চায়।তারা কার্যত ভোটবিমুখ মার্কা দেখে বা চায়ের বিনিময়ে ভোট দেয়।

আপনাদের সেই জনতার কাছাকাছি যেতেই হবে এবং তাদের ভাষায় নতুন রাজনীতির গল্প শুনাতে হবে। এনসিপি যদি সত্যিকার অর্থে একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে চায়, তাহলে এখনই সময় নিজেকে ঢেলে সাজানো। গঠনমূলক পরিকল্পনা, স্পষ্ট রাজনীতি ও বাস্তব সংযোগ—এই তিনের সমন্বয় ঘটাতে পারলে, এনসিপি আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম হতে পারে।

আর যদি তা না হয়, তবে ইতিহাসের পাতায় হয়ত শুধু লেখা থাকবে—একদল তরুণ এসেছিল, ফুল ফুটেছিল, কিন্তু গন্ধ ছড়াতে পারেনি।

 

লেখক: শাহ্ পরান

আরও পড়ুন