বৈশাখের দশম দিন। পহেলা বৈশাখে বাড়ি যাওয়ার কথা। অনেক দিন হয়ে গেছে, আরমানের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। তার বাড়ি হবিগঞ্জ, পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াতে তার স্বপ্ন এখন লুকোচুরি খেলছে বাড়ির প্রতি।
ট্রেনে সবাই চুপচাপ বসে আছে। শুধু একটি মেয়ে বিরামহীনভাবে কথা বলে যাচ্ছে। চোখের পলক ফেলতেই মেয়েটি তার সামনে এসে হাজির। মেয়েটি ভিখারিণী। কাধে দেড় বছরের একটি বাচ্চা ছেলে। মেয়েটিকে আরমানের বড় চেনা চেনা লাগছে ।
কয়েক বছর আগের কথা, আরমান যখন কলেজে পড়তো সবাই তার দিকে কিছুটা বাকা নজরে তাকিয়ে থাকতো শুধু তার পড়াশোনার প্রতি হিংসে দেখিয়ে। কলেজের বন্ধুরা এখন প্রবাসে, শুধু সেই একমাত্র পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কলেজে একটা মেয়ের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। মেয়েটির নাম লাবনী। নাম লাবনী হলেও গায়ের রং ছিল বিপরীত। গরীব বাবার পঞ্চম কন্যা। অর্থের অভাবে পড়াশোনা পর্যন্ত চালাতে পারছে না। কিন্তু মেয়েটি আরমানকে পছন্দ করে।
আরমান কাউকে 'তুই' করে ডাকতে পারে না। সবাইকে 'তুমি' করে বলে। সবাইকে 'তুমি' বলে ডাকতে পারার গুণত্বে মেয়েটি আরমানকে পছন্দ করে ফেলে। কিন্তু আরমান পড়াশোনাতে ভালো হলেও প্রেমের প্রতি তার আকর্ষণ নেই। মেয়েটি কলেজ জীবনের পুরোটা সময় তার কথা ভেবে কাটিয়েছে। কিন্তু আরমান বন্ধুত্বের সম্মান দিলেও প্রেমের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। লাবনী কালো হওয়াতে সব জাগাতেই অবহেলিত শুধু আরমানই তাকে বন্ধুত্বের সম্মান দিয়ে আগলে রেখেছে।
লাবনীর এক সময় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আরমান পড়াশোনা নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে লাবনীর খবর নেওয়ার মতো সময় তার হয়ে উঠে না। আরমানের সামনে ভর্তি পরীক্ষা। ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়বে তাই তার ভাবনা। কয়েক মাসের ব্যবধানে চান্স পেয়ে যায় ভার্সিটিতে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে হাজার মানুষের সাথে মিশে তার মানসিকতারও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নর-নারীর প্রেম বাস্তবতা সে অনেক কাছ থেকে দেখছে। তারও মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে হলেও একটা প্রেম করা দরকার কিন্তু তার প্রেম হয়ে উঠে না।
প্রথম দিকে আরমান যখন নিজ জেলা ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়, তখন লাবনী অনেক চেষ্টা করে আরমানের সাথে দেখা বা যোগাযোগ করার কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আরমানের সাথে তার আর কখনো দেখা হয়নি। গ্রামে কত বার গিয়েছে, কত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে কিন্তু একটি বারের জন্যও আরমান লাবনীর খোঁজ নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতায় আরমান পড়াশোনা নিয়ে আরো সিরিয়াস।
একদা কোনো একদিন আরমান হলের রিডিং রুমে পড়ছে, হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে তার ফোনে। পরদিন পরীক্ষা থাকাতে কলটা পর্যন্ত ধরেনি সে। ফোন করছিল লাবনী। লাবনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কোনো এক গরীব পরিবারের ছেলের সাথে এটা জানানোর জন্য লাবনী তাকে কল করেছিল। ঐদিন রাতে এ কথা জানতে পারে তার এলাকার এক বন্ধুর কাছ থেকে।
এখন বারবার তার লাবনীর কথা মনে পড়ছে। লাবনী তাকে কি পরিমাণ ভালোবেসেছিল তা এখন সে বুঝতে পারছে। সে কান্না করেও করতে পারছে না। সে মনে মনে ভাবছে, সে তো কখনো লাবনীর প্রতি দূর্বল ছিল না, সে কেন কান্না করবে?
বর্তমানে ট্রেনে তার সামনে থালা হাতে নিয়ে যে মেয়েটা দাড়িয়ে সে আর কেউ নয়, একটা সময় তাকে যে ভালোবাসতো সেই লাবনীই। কিন্তু লাবনীর এ কি দশা ? মাত্র কয়েক বছরের সংসার জীবনে তার এতো অধঃপতন! অথচ আরমান তার কিছুই জানে না । যে ছেলেটির সাথে লাবনীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেই ছেলেটির চরিত্রে ছিল অবনতি, ছিল নেশাগ্রস্ত। সংসার জীবনে টিকতে পারেনি লাবনী। বাবার অভাবের পরিবারে গিয়েও ঠায় পাইনি সে। পেটের দায়ে এখন সে ভিক্ষে করছে ।
আরমান লাবনীর দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে, লাবনীও চোখ ফিরাচ্ছে না। দু'জন দু'জনকে চিনতে পেরেছে অথচ কেউ কোনো কথা বলে না । আরমান পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বাচ্চা ছেলেটির হাতে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো আশ্চর্য সে এর আগে আর কখনো হয়নি। যে তাকে কোনো এক সময় এতো ভালোবাসতো তার এই পরিণতি দেখতে হবে তা সে কখনো ভাবেনি। আরমানের বুক ফাটা যন্ত্রণা কিন্তু চোখ দিয়ে কেন যে পানি আসছে না তার।
মনে মনে ভাবছে," আমি এক কঠিন স্বার্থপর মানুষ । সব সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। গ্রামের প্রতি, আশেপাশের প্রতিবেশির প্রতি কোনো নজর ছিল না আমার।"
কি করবে সে, কি করার আছে। লাবনী চলে যাচ্ছে অথচ এক বারের জন্য হলেও কথা বলতে পারছে না। ভিতর থেকে কে যেন টেনে আকড়ে ধরে আছে তাকে।
তাদের আর কথা হয়নি, হবেও না আর। ট্রেন চলছে ট্রেনের মতো করে। আরমান একবারের জন্যও কথা বলেনি ট্রেনে। তার নিস্তবদ্ধতা জাগান দিচ্ছে ভিতরকার বিবেককে। জীবনের এতো জ্ঞান, এতো সত্য জানার পরেও তার কাছে 'সুখ' এর সজ্ঞা অপরিচিত।
সুখ কী? সুখী কে ? যে সুখের কামনা করে নাকি
যে সুখকে চিনতে পারে। তার বিবেক জুড়ে শুধু এ মনোভাবনাই।
লেখক: মো. রাকিবুল ইসলাম, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC