জুন ৮, ২০২৫

রবিবার ৮ জুন, ২০২৫

উন্নয়নের ছদ্মবেশে বনায়ন ধ্বংস জাবিতে বৃক্ষনিধন ও জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন: উন্নয়ন নাকি পরিবেশ ধ্বংসের পাঁয়তারা

Rising Cumilla -Deforestation in the guise of development Deforestation and changes in biodiversity in JU Development or the catalyst for environmental destruction
ছবি: গ্রাফিক্স (প্রতিনিধি)

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, একটি প্রাণবন্ত সবুজ ক্যাম্পাস, যেখানে এক সময় প্রকৃতি, প্রাণিকুল ও মানুষ এক অপূর্ব সহাবস্থানের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের একমাত্র পরিকল্পিত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি গড়ে উঠেছিল গাছপালা, জলাশয়, প্রাকৃতিক ঢিবি এবং মৌসুমি পাখিদের মেলবন্ধনে এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচিতি কেবল একাডেমিক উৎকর্ষ নয়, বরং তার অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্যও সুপরিচিত। অথচ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উন্নয়নের’ নামে যে ধরনের বৃক্ষনিধন, ভূমি উচ্ছেদ এবং অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, তা প্রকৃতপক্ষে এক নিরব প্রকৃতি-গণহত্যার সূচনা করেছে।

বৃক্ষ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের যে চিত্র বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, তা বহু বছরের সুনির্মিত প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। পূর্বে যেখানে জাহাঙ্গীরনগর ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ, পশু-পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল, আজ সেখানে ক্রমাগত বৃক্ষনিধন এবং যত্রতত্র নতুন ভবন নির্মাণের ফলে সেই সহাবস্থান ভেঙে পড়ছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই উন্নয়ন কার্যক্রমে তেমন প্রয়োজনীয় কোনো সুনির্দিষ্ট পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment – EIA) করা হচ্ছে না, বা হলেও তা ভালোভাবে মানা হচ্ছে না। ফলে বৃক্ষনিধনের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা এখন টের পাচ্ছেন ক্যাম্পাসের আশেপাশের বাসিন্দা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় মানুষজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায়, হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নির্মাণকাজের জন্য মাটি ভরাট, বিভিন্ন কাঠামো ও কংক্রিটের ভবন বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগে যেখানে বর্ষা মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ পানি জমে পরিবেশকে শীতল করত, সেখানে এখন পানি সরে গিয়ে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে।

জলাভূমির অপ্রয়োজনীয় ও যত্রতত্র ভরাটের কারণে খাল, বিল, ও পুকুরে মাছের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, ব্যাঙ, কাঁকড়া, শামুক, কুচিয়া ও জলচর পাখি বিলুপ্তির পথে।

জীববৈচিত্র্যের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হচ্ছে দিন দিন। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরে বা স্থানে কালেভদ্রে দেখা মিলত বনরুই, শিয়াল, সজারু, গুইসাপ, বনবিড়াল সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি। এখন তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে প্রায়ই এসবের মধ্যে অনেক প্রাণীকে বিভিন্ন স্থানের রাস্তায় দিনে-দুপুরেও দেখা মেলে, যা শিক্ষার্থীসহ পথচারীদের চলাচলে অনেক সময় বাঁধার সৃষ্টি করে। অনেক সময় এসব প্রাণীর আক্রমণাত্মক আচরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করে।

পাখির কলকাকলি ছিল এখানকার নিত্যদিনের স্বাভাবিক দৃশ্য। অথচ এখন এসব প্রাণী হয় স্থানচ্যুত হয়েছে, নয়তো নির্মমভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেকেই। বাসস্থান হারানোর ফলে অনেক পাখি কিংবা প্রাণী তাদের স্বাভাবিক খাদ্যচক্র অনুসরণ করতে পারছে না। বন্য প্রাণীগুলো অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসছে, কারণ তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

এখানে প্রশ্ন আসে; এ কি সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন, না কি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রকৃতি ধ্বংসের পরিকল্পিত পাঁয়তারা? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন মানে শুধু দালান তৈরি নয়, বরং শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সুযোগ এবং মানবিক ও পরিবেশ সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলাই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তবে এখন আমরা যা দেখছি তা হলো, প্রশাসনিক অদক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে প্রকৃতি ধ্বংসকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে ‘অগ্রগতি’ হিসেবে।

অনেক পরিবেশবিদের মতে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি ক্ষুদ্র ইকোসিস্টেমের নিদর্শন, যেখানে বিভিন্ন স্তরের প্রাণীকুল ও উদ্ভিদজগৎ একে অন্যের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে। এই ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।

পরিকল্পিতভাবে একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে সেখানে কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে তোলা, তা যত আধুনিক সুবিধা দিয়েই সাজানো হোক না কেন, প্রকৃতির বিকল্প হতে পারে না কখনই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে নিচে নেমে গেছে, যা ভবিষ্যতে ক্যাম্পাসের পানির সংকটের জন্য ভয়াবহ বার্তা বয়ে আনছে।

প্রতিটি গাছ তার শেকড় দিয়ে ভূগর্ভস্থ জলধারার ভারসাম্য বজায় রাখে। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটা মানে কেবল ছায়া হারানো নয়, বরং অগণিত পাখি, প্রাণী ও মানুষের জীবনের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলা।

এই প্রেক্ষাপটে, আমাদের প্রশ্ন; এই ধ্বংসের দায়ভার কে নেবে? প্রশাসন কি শুধুই উন্নয়নের দায় নিচ্ছে, নাকি তারা প্রকৃতির ক্ষয়রেখাও বুঝে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে?

ছাত্র-শিক্ষক ও সচেতন নাগরিক সমাজ যদি এখনই সোচ্চার না হয়, তাহলে ভবিষ্যতের জাহাঙ্গীরনগর হবে এক মৃত, বিবর্ণ ও বৈচিত্র্যহীন অঞ্চল, যেখানে থাকবে শুধু কংক্রিটের দালান আর স্মৃতিতে গাঁথা বৃক্ষের নাম।

অতএব, এখনই সময় আমাদের জেগে ওঠার। প্রকৃতির নামে নয়, প্রকৃত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। জাহাঙ্গীরনগরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবশ্যই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা অগ্রাধিকার পেতে হবে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ, প্রাণবন্ত ও টেকসই পরিবেশ রেখে যাওয়াই হোক আমাদের সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। উন্নয়ন যেন ধ্বংসের মুখোশ না হয়; এই হোক আমাদের সোচ্চার আহ্বান।

আরও পড়ুন