ঘরের মেঝেতে লাফালাফির তীব্র শব্দে অন্য রুম থেকে ছুটে আসে আহাদ সাহেব। অনবরত লাফিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই তার দশ বছরের ছেলে ওহাব। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার সামনে। মুখ থেকে আওয়াজ তো দূরের ব্যাপার, নড়তেও পারছেন না। দেখেন, ছেলেটা লাফ দিয়ে প্রায় ৩-৪ হাত উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নামছে। সাথে খিলখিল শব্দে হাসছে।
আহাদ সাহেবের বাসাটা ঠিক মহসিন মঞ্জিলের দু’তলায়। উনার ইউনিটের অপজিটে আরেকটি ফ্যামিলি বাসা। তবে ওটাতে শুধু স্বামী-স্ত্রী থাকেন এবং সারাদিন ওটা থেকে ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসতো উনার কর্ণকুহরে এবং মাঝেমধ্যে তিনি গিয়ে তাদের শাসিয়ে আসতেন যেন ঝগড়া না হয়। কারণ তাদের ঝগড়ার ফলে আহাদ সাহেবদের ডিস্টার্ব ফিল হয়।
ও বাসার মহিলার স্বামী ছিল কিছুটা উদ্ভট টাইপের। জটলা পাকানো চুল, গোঁফে ছেয়ে গেছে মুখ। সাথে চেহারা ছিল কুচকুচে কালো রঙের। মহসিন মঞ্জিলের নিচতলার দুই ইউনিটে দুটো ফ্যামিলি থাকতো।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে অন্যদিন দু'তলাতে দেওয়ালের মধ্যে পেরেক গাঁথার শব্দ শুনে নিচতলার মানুষজন চলে আসতো। সন্দেহ লাগতো যে কোনো সমস্যা হল কি-না।
অথচ আজ এতো শব্দের মাঝেও উনাদের উপস্থিতি নেই ভেবে আহাদ সাহেব আরো অবাক হলেন। খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকার পর আচমকা তার ঘোর কেটে গেল। তার ছেলে দরজার বিপরীত পাশে পড়ার টেবিলে বসে পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং করছে।
তিনি ভাবতে লাগলেন তাহলে কি তিনি এতক্ষণ ভুল শব্দ শুনছেন! তার ছেলেকে লাফাতে দেখাটাও কি মনের ভুল ছিল! এসব কিছুরই তিনি হিসেব মেলাতে পারছেন না।
চিন চিন মাথা ব্যথা অনুভব করলেন। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে তিনি ওহাবের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন যে সে কি আঁকছে। দেখে ভয়ে হকচকিয়ে গেলেন। কলিজা যেন শুকিয়ে গেল। এ যে তার কৈশোরের ছবি স্কেচ করা, সাথে ওহাবেরও।
তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। স্বপ্ন দেখছেন না তো! হঠাৎ আজ তার সাথে কি সব আজব ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। আহাদ সাহেব ওহাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দরদ মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, এসব কী আঁকছো বাবা? এঁরা কারা? কী বলো বাবা! এঁদের তুমি চিনতে পারছো না? এ যে উপরেরটা আমার মিষ্টি আব্বুর স্কেচ, নিচেরটা তোমার লক্ষ্মী ছেলে ওহাবের।
আচ্ছা বাবা, তুমি আমার কৈশোরবেলার ছবি স্কেচ করলে কীভাবে? কী যে বলো বাবা! আমি কি স্কেচ করতে পারি নাকি? পেন্সিল দিয়ে হাত ঘুরাচ্ছি তো কেমন যেন মানুষের প্রতিকৃতি হয়ে গেল।
আর কে যেন আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, উপরের স্কেচটা তোমার বাবার এবং নিচেরটা তোমার। অট্টহাসিতে কথাটা বাতাসে মিলিয়ে গেল।
আহাদ সাহেব আশপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। কী বলছ তুমি! এসব তুমি আঁক নি? তাহলে কে আঁকলো? এ ঘরে তো আর কেউ আসেনি। আমি, তোমার মা পাশের রুমে খোশগল্প করছিলাম।
বাসার মূল দরজাও তো ভেতর থেকে লক করা। তাহলে কে আসতে পারে? তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিও না, ওহাব! আমি সত্যি বলছি বাবা, আমি ইচ্ছে করে এমন স্কেচ আঁকিনি।
এভাবে যে মানুষের চিত্র আঁকা হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি। অবশেষে আহাদ সাহেব ভেবে নিলেন যে ছোট মানুষ তাই হয়ত ভয়ে বলছে না। তবে ওহাব তো স্কেচ তেমন পারে না।
এমন নিখুঁত স্কেচ বড় আর্টিস্ট ছাড়া আঁকা সম্ভবপর নয়। যাহোক, ছেলে ভয় পাবে ভেবে এ বিষয়ে আর কিছুই বলেনি।
তবে আহাদ সাহেবের মনে একটা খটকা লাগল যে, এটার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক ব্যাপার লুকানো। এসব ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন ফ্রেশ হতে।
ওয়াশরুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে ফ্রেশ হয়ে যেই না লক খুলে বের হবেন তখনই ঘটলো আরেক বিপদ। দরজা কোনোভাবেই খুলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বাহির থেকে কেউ দরজা লক করে দিয়েছে।
আহাদ সাহেব অনেকক্ষণ যাবত দরজা টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি করেও দরজা খুলতে ব্যর্থ হলেন। চিৎকার করে ডাকাডাকি করেও কারো সাড়া পেলেন না।
খানিক বাদে তার মনে হলো, আরে! আমি তো ওয়াশরুমের লাইটের সুইচ অন করে প্রবেশ করলাম। তাহলে কে জেনে-বুঝে বাহির থেকে দরজা লক করবে? তিনি দরজাতে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলেন কিন্তু দরজা এক চুলও নড়াতে পারছেন না।
কেউ যেন দরজাতেও সুপার গ্লো লাগিয়ে দিয়েছে যেন দরজা একেবারে স্থির! ভিতরে গুমোট বাঁধা অন্ধকার। একটা বাজে গন্ধও তিনি অনুভব করলেন। জোরে জোরে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন কিন্তু বাহির থেকে কোনো সাড়াশব্দ তার কানে আসছে না।
মনে হয় তার চিৎকার,ডাকাডাকির আওয়াজ দরজা ভেদ করে বাহিরে যেতে অক্ষম। অতঃপর কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেলেন টেরও পাননি। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করেন খাটে।
একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন স্ত্রী মিতালির দিকে। মুখ থেকে আওয়াজ আসছে না। ইশারাতে ও, আ.. আ.. করছে। ওহাবের বড় বোন মিলি ডাক্তার নিয়ে এলেন।
ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, উনি হয়ত অনেক ভয় পেয়েছেন তাই উনার পালস্ এর গতি খুব বেশি এবং শরীরের তাপমাত্রাও অনেক।
কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি, এগুলো খাওয়ালে শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবে। তারপর ঔষধ-এর প্রেসক্রিপশন দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন।
কিছু সময়ের পর আহাদ সাহেবের মুখ থেকে টুকটাক শব্দ অস্পষ্টভাবে বের হতে লাগল। হঠাৎ ওহাবকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে শিশুর মতো কেঁদে ওঠলেন।
এমন আচমকা কান্নায় উনার দেখাদেখি উনার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে কাঁদতে লাগলেন। কান্নার রোল পড়ে গেল বাসায়।
আশপাশের বাসার সবাই ছুটে এসে দেখে তারা সবাই জড়িয়ে কাঁদছে। অথচ এমন কখনো হয়নি এ বাসায়। আজ কেন যে এভাবে উনারা কাঁদছে এ নিয়ে বাকি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের ভাবনার শেষ নেই।
পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে লোকেরা আহাদ সাহেবকে প্রশ্ন করে, কী হয়েছে ভাইজান? এভাবে সবাই কাঁদছেন কেন? আহাদ সাহেব কাঁদো কাঁদো স্বরে সকালে তার ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনা তাদের সাথে শেয়ার করেন।
এসব শুনে সবাই চমকে উঠেন! কী বলেন এসব ভাই! এগুলো আপনার মনের ভুল। ভুলে যান। আহাদ সাহেব নরম স্বরে বলেন- না রে ভাই, সত্যি ঘটনাই বলেছি।
তখন পাশের ইউনিটের উদ্ভট চেহারার লোকটার আগমন। তাকে দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন, ওহাব। অমনি আহাদ সাহেবের রক্তবমি শুরু হয়।
উদ্ভট লোকটি একদৃষ্টিতে আহাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি।
সাইদুল হাসান
সম্পাদক, কৈশোরিকা
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঠিকানা-
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কোটবাড়ি, আদর্শ সদর, কুমিল্লা।
মুঠোফোন - ০১৮৬৫০১৭৮১২
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC