আর্থিক সন্ত্রাস আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথাগত সন্ত্রাসের মতো সরাসরি জীবন কেড়ে না নিলেও, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এবং এর বিস্তার সমাজের মূল কাঠামোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলছে। এই 'নীরব' সন্ত্রাস সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
আর্থিক সন্ত্রাসের মূল ভিত্তি হলো অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন এবং সেই অর্থের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা। মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, ঘুষ, জুয়া এবং কর ফাঁকির মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সমাজের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এই অবৈধ অর্থের মালিকরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
আর্থিক সন্ত্রাসের সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রভাব হলো সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। তারা অস্বাভাবিক জীবনযাপন করে এবং বিলাসবহুল সম্পদে বিনিয়োগ করে।
এর বিপরীতে, সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং জীবনধারণের জন্য কঠিন সংগ্রাম করে। সুযোগের অভাব তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়, যা সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ।
অর্থনীতির উপর আর্থিক সন্ত্রাসের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। কালো টাকা অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিপথকে বিপথে চালিত করে। ফটকা বাজার, হুন্ডি এবং অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এই অর্থের লেনদেন অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বৈধ ব্যবসার পরিবর্তে অবৈধ ব্যবসার প্রসার লাভের সম্ভাবনা বাড়ে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাধা স্বরূপ।
দুর্নীতি ও অপরাধ আর্থিক সন্ত্রাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবৈধ অর্থের প্রভাবে নীতি নির্ধারক এবং সরকারি কর্মকর্তারা সহজেই প্রভাবিত হতে পারেন। এর ফলে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, যেমন - অর্থ পাচার, জালিয়াতি এবং অন্যান্য আর্থিক কেলেঙ্কারি বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতি সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
যখন সমাজের মানুষ প্রত্যক্ষ করে যে অবৈধ উপায়ে ধনী হওয়া ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে, তখন তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশা ক্ষীণ হয়ে আসে এবং সমাজে অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়। এই সামাজিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যেও এমন ব্যক্তি থাকতে পারে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধরনের অবৈধ কার্যকলাপের সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক এবং সামাজিক বয়কট একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে।
সামাজিক চাপ অনেক সময় অপরাধীদের মানসিক এবং সামাজিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে। একই সাথে, রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
অবৈধ পথে উপার্জনকারীরা প্রায়শই তাদের অর্থের ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার পরিচয় দেয়। দ্রুত ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং আর্থিক জ্ঞান ও পরিকল্পনার অভাবের কারণে তারা সাধারণত লোক দেখানো এবং সহজেই নজরে আসে এমন সম্পদে বিনিয়োগ করে।
দামি গাড়ি, বিশাল বাড়ি, ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ – এই ধরনের বিলাসবহুল জীবনযাপন খুব সহজেই জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের অবৈধ উপার্জনের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি করে। অস্বাভাবিক বিনিয়োগ, যেমন - অল্প সময়ে বিশাল আকারের জমি, প্লট বা রিসোর্ট কেনা স্বাভাবিক আয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ না হলে তা সন্দেহের জন্ম দেয়।
অন্যদিকে, যারা ছোটখাটো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে এবং সেই অর্থ বিভিন্ন উপায়ে লুকিয়ে রাখে, তারা সম্ভবত দীর্ঘ সময় ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে। তাদের কৌশল হলো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এবং বড় ধরনের বিনিয়োগ এড়িয়ে যাওয়া।
তবে, আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রযুক্তির উন্নতি এখন অনেক লুকানো লেনদেনও শনাক্ত করতে সক্ষম। সময়ের সাথে সাথে তাদের এই কৌশলও আইনের নজর এড়াতে পারবে কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
"জোর যার মুল্লুক তার' – এই নীতি যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যখন কোনো অপরাধী তার ক্ষমতা এবং প্রভাব খাটিয়ে ভুক্তভোগীকেই উল্টো দোষী বানানোর চেষ্টা করে, তখন সমাজে আরও বেশি অন্যায় এবং অবিশ্বাসের জন্ম নেয়।
অনেক সময় অবৈধ উপার্জনকারীরা একটি শক্তিশালী চক্র তৈরি করে, যেখানে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্যও জড়িত থাকতে পারে।
এই চক্র তাদের অপরাধ ঢাকতে এবং ভুক্তভোগীদের হয়রানি করতে সাহায্য করে। ভুক্তভোগীরা প্রায়শই প্রভাবশালী অপরাধীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পান, কারণ তারা জানে যে এর পরিণতি তাদের জন্য আরও খারাপ হতে পারে।
যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারে বা যদি আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিত হয়, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এই "জোর যার মুল্লুক তার" মানসিকতা সমাজে একটি অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ। সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
একই সাথে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষভাবে এবং দক্ষতার সাথে কাজ করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধী ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার না পায়। আর্থিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
সমাজের সকল স্তরের মানুষের সচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণই এই উদ্বেগের মোকাবেলা করতে পারে এবং একটি সুস্থ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হতে পারে।
মোঃ আল-আমিন
ব্যাংকার, এমবিএ (এআইএস)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC