মে ১২, ২০২৫

সোমবার ১২ মে, ২০২৫

আবেগ চলে যুগের তালে!

আবেগ চলে যুগের তালে!
আবেগ চলে যুগের তালে!

ফজলু ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। স্কুল থেকে বিকাল পৌনে পাঁচটায় বাড়ি ফিরেই মাকে জিজ্ঞাসা করল, মা , আব্বা কি হাটে চলে গেছে? মা বললো, ধান খেত থেকে এসে তারপর যাবে। কেনরে বাবা? ফজলু বললো, আমার বাংলা খাতাটা শেষ হয়ে গেছে, আমার জন্য একটা বাংলা খাতা আনতে বলিও। আচ্ছা বলব, তুই এখন ভাত খেয়ে গরুর জন্য ঘাস তুলে আন। একথা বলে তার মা সংসারের অশেষ কাজে পুনরায় নিমজ্জিত হলেন।

এদিকে ফজলু ভাত খেয়ে দ্রুত ঘাস তুলতে বেরিয়ে পড়ল। বিশ্রাম নিতে চাইলেতো খেলার সময় থাকবে না তাই দ্রুততা। খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় ঘাস তুলে খেলার মাঠে পৌঁছাতে সূর্যাস্তের আর ১০/১৫ মিনিট বাকি আছে।

ফজলু বন্ধুদের মিনতি করে বলে, আমাকে এক দলে নেস না। তোর জোড়া কই, তোকে কোন দলে নিব ? বন্ধুদের উত্তর। ফজলু এদিক ওদিক দেখছে, কাউকে পাওয়া যায় কিনা। সূর্যাস্তের অন্তিম মুহূর্তে হঠাৎ একজন খেলোয়াড় পায়ে ব্যথা পেয়ে মাঠ থেকে উঠে আসলে ফজলু সে দলের হয়ে নামার সুযোগ পেল।

ফজলু খুশি মনে নেমে বলের পিছনে ২/৩ মিনিট দৌড়াতে দৌড়াতে আজকের মত খেলা শেষ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই। ফজলু অনেক খুশি, কারণ অনেক দিনতো জোড়ার ও সময়ের অভাবে মাঠে নামাই হয় না। আবার অনেক অনেক দিনতো স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির তরকারি,কলা,পেপের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বিক্রির জন্য হাটে যেতে হত। প্রায় প্রতিদিনই সকাল বিকাল একটা না একটা কাজ থাকত।

কোন কোন সময় ধান মাড়াই এর কারণে গরুর পিছনে ঘুরতে ঘুরতে রাত ৯/১০ টা বেজে যায়। এমন সময় আব্বা হাট থেকে এলে দৌড়ে গিয়ে বাজারের খরচের থলিটা হাতে নিয়ে নিজ হাতে বাজার সামগ্রী বের করতে করতে ফজলু দেখতো খাওয়ার কিছু এনেছে কি না। অনেক সময় এনেছে, অনেক সময় আনেনি। না আনলেও আশাহত হতো না, পরের হাটে হয়তোবা আনবে।

ঈদের সময়ও ফজলু ও তার বোনদের তেমন নতুন পোশাক জুটতো না। হয়ত একটা গেঞ্জি, ছোট বোনদের জন্য একটা সাধারণ ফ্রক। তাতেই মহা আনন্দ।

সন্ধ্যায় ফজলু বাড়ি ফিরে বিছানা পেতে ঘণ্টা খানেক পড়েই মাকে বলে, মা ক্ষুধা লেগেছে। মা বললো ভাত খেয়ে নে। অমনি ভাত খেয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ধান মাড়াইয়ের গরুর পিছনে ঘুরে ঘুরে ধান মাড়াই করে পান্তা ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছিল। স্কুল থেকে ফিরে আসার পরের কাহিনি তো বলা হয়েছে। তাইজন্য এত ক্লান্তি।

গভীর রাতে ফজলুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজলু মাকে ডেকে বলে, মা আমি পেশাব করবো। মা চেরাগ জ্বালিয়ে দিলে, ফজলু বাহিরে গিয়ে পেশাব করে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করে, মা আব্বা কি খাতা এনেছে? ছেলেকে এতো রাতে কীভাবে এ কঠিন কথাটা বলবে, তাই মা বললেন, এনেছে বোধহয় এখন ঘুমা।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজলু আব্বাকে জিজ্ঞাসা করে, আব্বা খাতা এনেছেন? আব্বা গরম হয়ে বলে, খাতা দিয়ে কি করবি ? রাত ৯/১০ আগেই তো ঘুমিয়ে যাস। সামনের হাটে আনমু। এভাবেই ফজলুর দিন চলছে।

SSC প্রথম বিভাগে পাশের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য ফজলু শহরে গমন করেন। বাবার দেওয়া সামান্য টাকার সাথে লজিং টিউশনি করে অনেক কষ্ট করে ফজলু স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

এর পরপরই সংসারের উন্নতির জন্য বাবার নির্দেশে ফজলু বিদেশে যান। কয়েক বছর পর দেশে আসার পর ফজলু পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করে। জীবনের প্রথম নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েই ফজলু একটা সরকারি পেয়ে যায়।

ত্রিশ ছুঁই ছুঁই এমন বয়সে ফজলু বিয়ে করেন। সংসার হলো, ছেলে মেয়ে হল। সংসারে কোন অভাব অনটন নেই। ফজলু ছেলে মেয়েদের জন্য রিমে রিমে কাগজ, ডজনে ডজনে কলম এবং পূর্ণ চাহিদা মিটিয়ে লেখা পড়া করাচ্ছে।

এত সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও ছেলে মেয়েরা পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে। বিকেলে ছেলেকে মাঠে গিয়ে খেলতে বললে, ছেলে মাঠে না গিয়ে লুকিয়ে মোবাইল গেইম খেলছে। প্রায় প্রতিদিনই ফজলু বাজার থেকে সদাই ও কোন না কোন খাবার জিনিস নিয়ে এসে ছেলে মেয়েদের ডাকা সত্ত্বেও তারা তেমন আগ্রহ দেখায় না।

অগত্যা ফজলু ছোট বেলার মত নিজ হাতে বাজার সামগ্রী বের করে, খাবার জিনিস ডেকে ডেকে দেন আর ভাবেন। কিন্তু কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারেন না। এসবের জন্য দায়ী কে? তার ভাগ্য নাকি সন্তানদের সহজ প্রাপ্যতা নাকি অন্য কিছু?

 

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (কবি মিজান পঞ্চায়েত)

আরও পড়ুন