
শিক্ষা জীবনের মৌলিক ভিত্তি, যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি হয় কেবল বই মুখস্থ, নম্বরনির্ভরতা এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করার দৌড়, তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক প্রকার মানসিক চাপ।
আমাদের সমাজে অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনাকে একটি বোঝা হিসেবে দেখছে, কারণ এই শিক্ষায় নেই আনন্দ, নেই কল্পনার স্বাধীনতা বা সৃজনশীল চর্চার সুযোগ।
অথচ প্রকৃত শিক্ষা হওয়া উচিত এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শেখার আনন্দ থাকবে, কৌতূহল থাকবে, থাকবে আত্মপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা। আনন্দ ও বিনোদন থেকে বঞ্চিত একটি শিক্ষা কখনোই একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না।
বরং তা জন্ম দেয় যান্ত্রিক, মুখস্থ নির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসহীন এক প্রজন্ম। তাই সময় এসেছে শিক্ষাকে প্রাণবন্ত ও আনন্দময় করার দিকে মনোযোগ দেওয়ার।
বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তনশীল সমাজে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য কেবল তথ্য অর্জন কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নয়। বরং শিক্ষা হওয়া উচিত একটি আনন্দময়, চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং মানবিক বিকাশের রূপান্তরকেন্দ্র।
এই বিবেচনায় বলা যায়, আনন্দ ও বিনোদনবিহীন শিক্ষা কখনোই প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী কেবল বই মুখস্থ করে, পরীক্ষা দেয় এবং সার্টিফিকেট অর্জন করে এটিকে যদি শিক্ষা বলা হয়, তবে তা আত্মবিকাশের প্রকৃত চাবিকাঠি নয়। আনন্দ ও মনোজ্ঞ উপাদান মিশ্রিত না হলে শিক্ষা হয়ে পড়ে নীরস, যান্ত্রিক এবং ক্লান্তিকর।
শিক্ষা এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে শেখার সঙ্গে আনন্দের যোগসূত্র না থাকলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আনন্দ এবং কৌতূহলবোধ হচ্ছে শেখার প্রকৃত অনুপ্রেরণা।
যে শিক্ষার্থী আনন্দ নিয়ে শেখে, সে বিষয়বস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে সহজে এবং স্থায়ীভাবে। অন্যদিকে, জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা কেবল মুখস্থ বিদ্যায় পরিণত হয়, যা পরীক্ষার পর পরই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আনন্দ, খেলা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে। ফিনল্যান্ড, জাপান বা নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় খেলাধুলা, নাটক, সংগীত, ছবি আঁকা, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় এসবের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তারা বিশ্বাস করে, শিশুদের মনোজগতে আনন্দ না আনলে জ্ঞান গ্রহণের প্রক্রিয়া কার্যকর হয় না। শেখার সময় শিশু যদি মজা পায়, তাহলে সে পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থাটি এখনও অনেকাংশে মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষা ভিত্তিক এবং নম্বর কেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস, এরপরে কোচিং, হোমওয়ার্ক এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সময় কাটে।
তাদের মনে আনন্দ বা সৃজনশীল চর্চার সুযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে। ফলে শিক্ষার্থীরা একসময় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা শেখে শুধু ‘পাশ করার’ জন্য, শেখে না জানার জন্য।
শিশুরা প্রাকৃতিকভাবে অনুসন্ধিৎসু ও কল্পনাপ্রবণ। তারা খেলে, প্রশ্ন করে, কৌতূহল নিয়ে জগৎকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি সেই কৌতূহলকে দমন করা হয়, যদি শুধু মুখস্থ বিদ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে সেই শিশু তার মেধা বিকাশের সুযোগ পায় না। তার মন বিষণ্ন ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক যদি শুধু পড়া ধরেন, বকাঝকা করেন এবং শাস্তি দেন, তাহলে শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানার্জনের আগ্রহ জন্মায় না।
বরং শিক্ষক যদি পাঠদানকে আনন্দদায়ক করে তোলেন, গল্পের মতো করে বিষয় উপস্থাপন করেন, উদাহরণ দিয়ে শেখান তবে শিক্ষার্থীরা সহজে মনোযোগী হয় এবং শেখার আগ্রহ তৈরি হয়।
অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অনেক সময় দেখা যায়, তারা শুধু ফলাফল ও গ্রেডের পেছনে ছুটতে থাকেন। সন্তান কত নাম্বার পেল, কোন পজিশনে আছে এসবেই সন্তুষ্টি খোঁজেন।
অথচ সন্তানের মানসিক আনন্দ, সৃজনশীলতা বা নৈতিক বিকাশের দিকে নজর দেন না। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে একটি বোঝা হিসেবে গ্রহণ করে।
আনন্দময় শিক্ষা মানে শুধু খেলাধুলা বা মজার গল্প বলা নয়। এটি একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা দর্শন, যেখানে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম যেমন খেলাধুলা, গান, নাটক, চিত্রাঙ্কন, প্রকল্পভিত্তিক কাজ, বিতর্ক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
এসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশে ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে তারা শুধু তথ্য মুখস্থ করে না, বরং তা বিশ্লেষণ করে, নতুন কিছু তৈরি করে এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ তৈরি করতে পারে।
স্কুলে যদি প্রতিদিন কিছুটা সময় খেলাধুলা, গান-বাজনা, গল্প বা শিল্পচর্চার জন্য নির্ধারিত থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে চাঙা থাকবে। তাদের মধ্যে বিরক্তি আসবে না, শেখার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। খেলাধুলা শুধু শরীরচর্চা নয়—এটি দলবদ্ধতা, নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা এবং মনোবল গঠনের প্রশিক্ষণও বটে।
প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলা যায়। অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন, অ্যানিমেশন, ইন্টারঅ্যাকটিভ গেইম, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এসব ব্যবহারে শিশুরা বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশের অনেক স্কুলে এখন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহার হয় খুব সীমিত আকারে। এই প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার শিক্ষাকার্যক্রমে আনন্দ বাড়াতে পারে বহুগুণে।
আনন্দ ও সৃজনশীলতাহীন শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ভয়াবহ। শিক্ষার্থীরা কেবল সার্টিফিকেট অর্জন করে, কিন্তু তারা সমাজে একজন চিন্তাশীল, মানবিক ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে থাকে না কর্মপ্রেরণা, আত্মবিশ্বাস বা নেতৃত্বগুণ। এতে করে জাতি হারায় সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থী হাসিমুখে স্কুলে আসে, আনন্দ নিয়ে শেখে, এবং প্রতিদিন কিছু নতুন কিছু জানার ইচ্ছা নিয়ে বাড়ি ফেরে। স্কুল হতে হবে এমন এক জায়গা, যেখানে শাসন নয়, উৎসাহ থাকবে; ভয় নয়, বন্ধুত্ব থাকবে; নিরুত্তাপ নয়, প্রাণবন্ত পরিবেশ থাকবে।
শিক্ষাকে যদি আনন্দময় ও জীবন্ত করতে হয়, তবে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন আনন্দঘন ক্লাস কার্যক্রম, সহপাঠ্যক্রমিক প্রতিযোগিতা, মুক্তচিন্তা চর্চার সুযোগ, প্রকৃতির মাঝে পাঠদান, খোলা মাঠে বিজ্ঞান বা সাহিত্য পাঠ ইত্যাদি কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।
এতে শিক্ষার্থীরা মুক্তভাবে চিন্তা করতে শিখবে এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাস্তবতাকেও উপলব্ধি করতে পারবে।
এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে। শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু পাস-ফেল নির্ধারণের মাধ্যম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক বিকাশের হাতিয়ার এই উপলব্ধি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি পাঠক্রমে আনন্দ, কল্পনা ও সৃজনশীলতা যুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষাকে প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষা উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আনন্দভিত্তিক পাঠদানের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইসাথে শিক্ষার্থীদের মতামত, আগ্রহ ও স্বপ্নকে সম্মান জানিয়ে সেই অনুযায়ী পাঠ্যবিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপন করতে হবে।
উপসংহারে বলা যায়, আনন্দ ও বিনোদনবিহীন শিক্ষা হচ্ছে এক ধরনের চাপ ও শৃঙ্খল, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতাকে বন্দি করে রাখে। সত্যিকার শিক্ষা তখনই হয়, যখন তা আনন্দের সঙ্গে মিশে যায়, মনকে মুক্ত করে চিন্তা করতে শেখায় এবং জীবনকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
যদি আমরা একটি উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও আনন্দময় প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনন্দ, কল্পনা এবং বাস্তবমুখী শিক্ষার অনুষঙ্গ যোগ করতেই হবে।
আমরা যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এখন আনন্দঘন মুহূর্ত করে তুলতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। রুটি রুটিন মাফিক বা মুখস্থ শিক্ষা মানুষকে একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং শিক্ষাপ্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের অনীহা সৃষ্ট করে থাকে।