মে ২৩, ২০২৫

শুক্রবার ২৩ মে, ২০২৫

আনন্দধারা: বইপ্রেমী রাকিবের অনুপম নিদর্শন

Rising Cumilla - Anandadhara
বাড়ির মূল ফটকও সাজানো হয়েছে বুক সেলফের আদলে | ছবি: প্রতিনিধি

‘আনন্দধারা’ বাড়িটির নাম। নামটি যতটা না শুনতে ভালো লাগে, তার চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করবেন যখন আপনি নিজ চোখে তা দেখবেন। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যাবে আপনার হৃদয়-মন, আপনি যখন দেখবেন কোন বাড়ির দেয়াল সদা জাগ্রত বুক সেলফ। তখন আহ্লাদে পুলকিত হবে আপনার আত্মা। বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরে ৩৩টি কালজয়ী লেখকদের বইয়ের মোড়ক শোভা পাচ্ছে ।

সাজানো রয়েছে— মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির মতো বহু পাঠকনন্দিত বই। বলছি কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেখাঁর ভান্ডা গ্রামের বই প্রেমী রাকিব হাসান ভূঁইয়ার কথা। তিনি তার বাড়ির সীমানা প্রাচীরে ইট পাথরের বদলে সাজিয়েছেন বইয়ের মোড়কে। গেটের দু’পাশের সীমানা প্রাচীর যেন বুক সেলফ। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে
শত শত মানুষ ভিড় করেন বাড়িটি দেখতে।

জানা গেছে, বাজিতপুর উপজেলার কালেখাঁ ভান্ডা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়ার ছেলে রাকিব হাসান ভূঁইয়া। ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি একজন বইপ্রেমী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। তার পরিবারের সবার বইয়ের প্রতি রয়েছে আসক্তি। শৈশবে একটি লাইব্রেরি ছিল বাড়িতে , সবাই খুব আগ্রহ সহকারে বই পড়তেন। তার বড় ভাই একজন লেখক। বই প্রেমী প্রয়াত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর বইয়ের প্রতি মানুষের উৎসাহ জোগাতে কালজয়ী কিছু বইয়ের মোড়কে তার বাড়ির প্রাচীরটি নান্দনিক সাজে সাজিয়েছেন তিনি।বাজিতপুরের সরারচর রেল স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জে যেতে দেখা মিলবে আনন্দধারা নামে বাড়িটির। বাড়িতে প্রবেশের প্রধান গেটটি দেখতে ঠিক বইয়ের মতো। চৌদ্দ ফুট উঁচু, নব্বই ফুট দীর্ঘ প্রাচীরজুড়ে বাংলা সাহিত্যের ৩৩টি কালজয়ী বই স্থান পেয়েছে।

গ্রন্থ প্রাচীর দেখতে আসা একজন দর্শনার্থীর সাথে সম্প্রতি কথা হয়। তিনি সরারচরের হাজী এডভোকেট ওসমান গণি মডেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। নাম
রাজ্জাকুন্নাহার সুমি।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল গেমস, ফেইসবুক এবং ইউটিউবে আসক্ত। তারা বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস জানেন না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন রাকিব হাসান দেখিয়েছেন বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। মানুষকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করার তার যে প্রয়াস তা অতুলনীয়। তার এমন উদ্যোগে ছেলেমেয়েরা কালজয়ী বই ও লেখকদের সম্পর্কে জানবে। বই মানুষকে আলোর পথ দেখায় তা তারা বুঝতে পারবে।

বাড়ির দেয়ালও সেজেছে বুক সেলফের আদলে | ছবি: প্রতিনিধি

মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থী উম্মে হাবীবা। তিনি বলেন, ”আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি বাড়িটি দেখার জন্য। এখানকার অনেকগুলো বই আমাদের ঘরে আছে। বাকি বইগুলোর নাম লিখে নিচ্ছি।”

রাকিব হাসান ভূঁইয়ার মা শতবর্ষী শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির প্রাচীরের এই কাজ দেখতে অনেক লোকজন আসছেন। বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাড়িতে একটি লাইব্রেরি ছিল। ছেলেমেয়েদের বই প্রীতি আমাকে আনন্দ দেয়।’

মো. রাকিব হাসান ভূঁইয়া মুঠেফোনে জানান, বইয়ের আদলে বাড়ির সীমানা প্রাচীর নির্মাণের ধারনাটি এসেছে ২০১৫ সালের জাতীয় বইমেলায় গিয়ে। সেখানে একটি প্রকাশনীর স্টল দেখেছিলেন তিনি। বুক সেলফের মতো সীমানা প্রাচীর নির্মাণে দক্ষ কারিগর পেতে ছয় মাস খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে তাঁকে। কারিগরদের সাথে দিনরাত শ্রম দিয়ে কালজয়ী বইযগুলোর মোড়কের আদলে প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়।

তিনি বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একজন মানুষের প্রকৃত বন্ধু বই। একজন বন্ধু ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু বই সারাজীবন বাতিঘর হয়ে পথ দেখায়।নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতির ইতিহাস,ঐতিহ্য তুলে ধরতে বাড়িতে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার করবো।”

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ৩৩টি পাঠকনন্দিত বইয়ের মোড়ক শোভা পাচ্ছে সীমানাপ্রাচীরে। বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের লোকজন ভিড় করছেন। রেললাইনের পাশে বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ট্রেনে যেতে যেতেও। অভিনব বাড়িটি দেখে রাকিবের সৃজনশীল চিন্তা ও রুচির প্রশংসা করছে সচেতন মহল।

এ অভিনব উদ্যোগ বইয়ের প্রতি সব শ্রেণির মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে।

আরও পড়ুন