মার্চ ১২, ২০২৫

বুধবার ১২ মার্চ, ২০২৫

সাহরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হল: এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা

প্রতীকি ছবি/সংগৃহীত

রাত যত গভীর হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ব্যস্ততা ততই বাড়ে। দিনের ক্লান্তি শেষে যখন অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে, তখন হলের ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয় নতুন এক প্রাণচাঞ্চল্য। বিশেষ করে রমজান মাসে এই দৃশ্য হয়ে ওঠে আরও ব্যতিক্রমী। সাহরি খাওয়ার আয়োজন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গল্প, এবং ইবাদতের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটে এই সময়টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সাহরি যেন শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রমজান মাসে হলের পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। দিনের ব্যস্ততা শেষে রাতের নির্জনতায় সাহরির আয়োজন ছাত্রদের জন্য নিয়ে আসে এক ভিন্ন আমেজ। হলের করিডোরে সারারাত জেগে থাকা শিক্ষার্থীদের হাঁটাচলা, রুম থেকে রুমে ডাকাডাকি, একসঙ্গে সাহরি খাওয়ার প্রস্তুতি—সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় এক বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ।

সাধারণত, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ক্যান্টিনে সাহরির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। কেউ কেউ নিজে রান্না করে সাহরি খায়, আবার কেউ বাইরে থেকে খাবার এনে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর সাহরি আয়োজনের ধরন ভিন্ন হতে পারে। অনেক হলে ক্যান্টিনে নির্দিষ্ট সময়ে সাহরি পরিবেশন করা হয়। সাধারণত খিচুড়ি, ডিম ভাজি, মুরগির কারি, ডাল—এইসব সাধারণ খাবারই সাহরির মূল অংশ। কিছু কিছু হলে ছাত্ররা নিজেরাই রান্না করে বা বাইরে থেকে খাবার কিনে আনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাহরি মানেই শুধু খাবার গ্রহণ নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা আর স্মৃতির এক বিশাল ভাণ্ডার। একসঙ্গে বসে সাহরি খাওয়া, ক্লান্তি ভুলে আড্ডায় মেতে ওঠা—এসব মুহূর্ত শিক্ষার্থীদের জীবনের স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকে।

অনেক শিক্ষার্থী বলেন, সাহরির সময়টা বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো মানে হল জীবনের ক্লান্তি ভুলে একসঙ্গে কিছু সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা এই সময়টায় নিজেদের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নেয়। এমনকি যারা বাড়ি থেকে দূরে থাকার কারণে একা অনুভব করে, তারাও এই সময়টায় বন্ধুদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাহরির অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘গ্রুপ সাহরি’। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে খাবার কিনে এনে বা রান্না করে সাহরি করে। কেউ রান্না করে, আবার কেউ শুধু পরিবেশনের দায়িত্ব নেয়। এভাবে সাহরির আয়োজন শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বন্ধনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

অনেক হলে ক্যান্টিনে খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট। সাহরি ও ইফতারের সময় ভিড়ের কারণে অনেক সময় খাবার শেষ হয়ে যায়, ফলে অনেকে উপযুক্ত সাহরি খেতে পারে না। এছাড়া রমজান মাসে রাত জেগে পড়াশোনা এবং সাহরি খাওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর শারীরিক ক্লান্তি বাড়ে।

বিশেষ করে যারা পরীক্ষা বা গবেষণায় ব্যস্ত, তাদের জন্য এই চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। গভীর রাতে সাহরি খেয়ে আবার সকাল থেকে ক্লাস বা পরীক্ষা—সব মিলিয়ে রোজা রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য সময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাহরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আত্মিক উন্নয়ন। অনেক শিক্ষার্থী সাহরির সময়টা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটায়। কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ পড়া, দোয়া করা—এসবের মধ্য দিয়ে তাদের আত্মিক প্রশান্তি আসে।

বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী পরিবার থেকে দূরে থাকে, তাদের জন্য রমজান মাস অনেক আবেগের সময়। এই সময়টা তারা বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে নিজেদের একাকিত্ব দূর করে। কেউ কেউ হলের মসজিদে গিয়ে সাহরি খাওয়ার পর জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করে। এটি তাদের ঈমানি চেতনাকে আরও দৃঢ় করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন রমজান মাসে শিক্ষার্থীদের সাহরি ও ইফতারের সুবিধার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। অধিকাংশ হলে ক্যান্টিনে বিশেষ সাহরি মেনু চালু করা হয়। কিছু হলে প্রশাসনের উদ্যোগে ফ্রি ইফতার ও সাহরির ব্যবস্থাও করা হয়।

তবে অনেক সময় প্রশাসনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে ভালো মানের খাবার নিশ্চিত করার দাবি জানায়। বিশেষত রমজান মাসে খাবারের মূল্য কমানো ও মান উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের আরও মনোযোগ প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কাটানো সাহরির স্মৃতি শিক্ষার্থীদের জীবনে এক বিশেষ জায়গা দখল করে থাকে।

ক্যাম্পাস ছাড়ার পরও এই সময়ের কথা তারা ভুলতে পারে না। বন্ধুত্বের এই গল্প, রাত জাগা, একসঙ্গে রান্না করা বা বাইরে থেকে খাবার আনা—এসবই তাদের স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকে।

অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, সাহরির সময়টায় তারা নিজেদের জীবন সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছেন। বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সেই সময় তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সাহরি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি বন্ধুত্ব, সমন্বয় এবং সহমর্মিতার প্রতীক। সাহরির সময় একত্রে বসে খাওয়া, গল্প করা এবং ইবাদত করার অভ্যাস শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

এই অভিজ্ঞতা তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলে, বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং রমজান মাসের শিক্ষা হৃদয়ে গেঁথে রাখে। সাহরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হল—এই দুইয়ের মেলবন্ধন শিক্ষার্থীদের জীবনে এক অপূর্ব স্মৃতি হয়ে থাকে, যা তারা সারাজীবন মনে রাখে।