নভেম্বর ৮, ২০২৪

শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪

নতুন উদ্ভাবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নাটোরের মৎস্য অঙ্গন

Natore's fishing grounds set a precedent for innovation
নতুন উদ্ভাবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নাটোরের মৎস্য অঙ্গন। ছবি: সংগৃহীত

নতুন উদ্ভাবনে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে নাটোরের মৎস্য অঙ্গন। এখন পুকুর আর দীঘি থেকে আহরণ করা কার্প জাতীয় মাছ মারা যাচ্ছে না। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঐসব মাছ রাখা হচ্ছে জীবন্ত। আর এ জীবন্ত মাছ নাটোর থেকে দেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

বৈচিত্র আর উদ্ভাবনে অনন্য নাটোরের কৃষি আর মৎস্য অঙ্গন। ইতোপূর্বে জেলায় উদ্ভাবন হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বিনাহালে রসুন চাষের প্রযুক্তি। এবার ক্রেতাদের হাতে জীবন্ত মাছ পৌঁছে দেওয়ার প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এ প্রযুক্তিতে পুকুর আর দীঘি থেকে আহরিত কার্প জাতীয় মাছ দিন-রাত ধরে পানিতেই জিঁইয়ে রাখা হচ্ছে। জলমহালে মাছ ধরার পরে জলকরে জালের মধ্যে থাকছে মাছ। খুব অল্প সময়ে অতিকায় হাঁড়িতে করে মাছগুলোকে পর্যায়ক্রমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পানির বাহনে! ঐ পানির বাহন দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নাটোর থেকে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ চট্রগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়ার মত বড় শহরে।

পানির বাহন হচ্ছে মোটা পলিথিন অথবা ত্রিপলে ট্রাকের পুরো শরীর আচ্ছাদিত করে সেখানে পানির আধার তৈরী করে নেয়া। ট্রাকের মাথার উপরে শ্যালো মেশিনে ঐ পানিই চক্রাকারে প্রবাহিত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, পানিতে অক্সিজেনের পরিমান ঠিক রেখে মাছগুলোকে জীবন্ত রাখা। প্রয়োজনে পথিমধ্যে পানিকে পরিবর্তন করে নেওয়া।

সারাদিন আর রাতে নাটোরের মহাসড়কগুলোতে পানি আর মাছের বাহন ট্রাকগুলোর সরব উপস্থিতি। জেলায় কার্প জাতীয় মাছের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত গুরুদাসপুর উপজেলার মহারাজপুর আর বড়াইগ্রাম উপজেলার মৌখাড়া এলাকাতে মৎস্য চাষিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এ প্রযুক্তির উদ্ভাবন করলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে অবশিষ্ট পাঁচটি উপজেলাতেও।

২০০৬ সালের দিকে ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী হয়েছিল। ঐ সময়ে মাছে ফরমালিন ব্যবহারের প্রসঙ্গ ছিলো ব্যাপক আলোচিত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারত আর মায়ানমারের রাসায়নিক মেশানো রুই জাতীয় মাছ কিনতে ক্রেতাদের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে নতুন নির্মিত দেশের প্রথম টোল মহাসড়ক বনপাড়া-হাটিকুমরুল আশীর্বাদ হয়ে ওঠে।

ঐ মহাসড়ক ধরে গুরুদাসপুর আর বড়াইগ্রামের মৎস্য চাষিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে স্থানীয় বাহন নছিমন বা ভটভটিতে পানির আধার তৈরী করে শ্যালো মেশিনে আবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাছ নেয়া শুরু হয় সিরাজগঞ্জের মহিষলুটি মাছের আড়তে। ঐ আড়তে আসা ঢাকার পাইকারী ক্রেতারা জীবন্ত মাছ দেখে বিষ্ময়াভিভূত হন।

পরবর্তীতে রাস্তার পরিধি বেড়ে যমুনা ব্রীজ পার হয়ে মাছ যেতে শুরু করে সরাসরি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে। দীর্ঘ পথ বিবেচনায় পানির বাহন নছিমনের পরিবর্তে জায়গা করে নেয় তিন টন আর পাঁচ টনের ট্রাকগুলো।

বড়াইগ্রাম উপজেলার মৌখাড়া এলাকার মৎস্য চাষি মতিউর রহমান সুমন জানান, মৌখাড়া আর মহারাজপুরের মৎস্য চাষিরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে নতুন এ প্রযুক্তির প্রবর্তন করেছেন। এখন এ প্রযুক্তি এজেলাসহ রাজশাহী এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এই মৎস্য চাষি আরো বলেন, মাছ চাষের মাধ্যমে মাওয়া ফেরীঘাট আড়তে আমাদের পাঠানো গড়ে দুই কেজি ওজনের এক হালি রুই মাছ বিক্রি হয় গড়ে দুই হাজার টাকা দরে। এছাড়া কাতল, মৃগেল, সিলভারকার্প, ব্লাককার্প মাছও পাঠানো হয় মাওয়াঘাটের তিনটি আড়তে। ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও বাড্ডার মাছের আড়তের প্রত্যেকটিতে এ এলাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে অর্ধশত ট্রাক যায়। মিরপুর, নিউমার্কেট, ফুলবাড়ি, কালিয়াকৈড় ছাড়াও চট্রগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াতেও জীবন্ত মাছের ট্রাক যায়।

বড়াইগ্রাম পৌরসভার মেয়র মাজেদুল বারি নয়নও একজন মৎস্য চাষি। তিনি বলেন, এ এলাকাতে শিক্ষিত মানুষের মাঝে মাছ চাষের ঝোঁক বেড়েছে। জীবন্ত মাছের বিরাট বাজার তাদের আগ্রহ তৈরী করেছে। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবিকায়নের এ পথ ধরে এলাকার আর্থ-সামাজিক অঙ্গনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

নাটোর শহর এলাকার মৎস্য চাষি প্রভাষক আব্দুস সালাম বলেন, নাটোরে বসে রাজধানীবাসীকে এ এলাকার স্বাদু পানির ফরমালিনমুক্ত সুস্বাদু মাছ খাওয়াতে পারছি বলে আমাদের প্রশান্তি। এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নাটোরে মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। শুধু মৎস্য চাষিরাই আর্থিকভাবে সুবিধা পেয়েছেন তা নয়, মৎস্য খামারগুলোতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে। জীবন্ত মাছবাহী ট্রাকগুলোর মালিক ও চালকেরাও বাড়তি আয়ের সুবিধা পাচ্ছেন। এ কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে মাছের ট্রাকে পানি সরবরাহ ব্যবসায়ও চালু হয়েছে।

নাটোর সদর উপজেলার সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আয়েশা খাতুন জানান, প্রতিদিন এ এলাকা থেকে গড়ে দেড় শতাধিক জীবন্ত মাছের ট্রাক যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। প্রত্যেক ট্রাকে ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি মাছ থাকে।

অনেক সময় মাছের ট্রাক থেকে রাস্তায় পানি পড়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে আয়েশা খাতুন বলেন, সময়ের প্রয়োজনে এ প্রযুক্তি আগামীতে অবশ্যই উন্নত হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় মাছের বাৎসরিক চাহিদা ৪৪ হাজার টনের বিপরীতে মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৭৪ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদনের বছরে জেলায় ৩০ হাজার টন মাছ উদ্বৃত্ত। এ উৎপাদনের বেশীরভাগটাই পুকুর ও দীঘির মাছ। জেলা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টন কার্প জাতীয় মাছ প্রতি বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে যাচ্ছে।

নতুন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জেলার মৎস্য চাষিরা নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের আর্থিক বুনিয়াদ সুসংহত হয়েছে। এ কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে মৎস্য চাষিদের সহযোগিতা দিয়ে যাবে মৎস্য বিভাগ।