মে ১১, ২০২৫

রবিবার ১১ মে, ২০২৫

ত্যাগের রক্তলিপি: ঈদুল আযহার অন্তর্যাত্রা

ত্যাগের রক্তলিপি: ঈদুল আযহার অন্তর্যাত্রা
ত্যাগের রক্তলিপি: ঈদুল আযহার অন্তর্যাত্রা

রক্তিম সূর্যের আলো যখন কেঁপে কেঁপে নামে ঈদের সকালে, তখন বাতাস যেন হয়ে ওঠে ধ্যানমগ্ন কোনো ফকির, যার ঠোঁটের কোণে উচ্চারিত হয় তাকবিরের ধ্বনি—“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”

চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত পবিত্রতা—যা ঘুম ভাঙায় শহরের অলস জানালা, জাগিয়ে তোলে গ্রামীণ উঠোনের শিশিরভেজা ঘাস। ঈদুল আযহা এসে দাঁড়ায় আমাদের হৃদয়ের দোরগোড়ায়—একটি উৎসব হয়ে নয়, এক মহাকাব্য হয়ে; ত্যাগ, বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণের এক গৌরবময় কাহিনি হয়ে।

ঈদুল আযহার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক স্নেহময় পিতা ও আত্মত্যাগী পুত্রের অনন্য কাহিনি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন প্রভুর আদেশে নিজের প্রিয় পুত্রকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত হলেন, তখন সেটি ছিল মানব ইতিহাসের এক অতুলনীয় মুহূর্ত—যেখানে বিশ্বাস জিতেছিল ভালোবাসার চূড়ান্ত আবেগকে অতিক্রম করে।

পুত্র ইসমাইল (আ.) যখন পিতাকে বললেন, “পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজনরূপে পাবেন,”—তখন কেবল ঈমান নয়, মানবতার আত্মাও কেঁপে উঠেছিল।

এই ঘটনাই ঈদুল আযহার অন্তরাত্মা। কুরবানি মানে কেবল পশু জবাই নয়, বরং আত্মার অভ্যন্তরে জমে থাকা অহংকার, লোভ, হিংসা, হঠকারিতা, অবিশ্বাস—এইসবকে কেটে ফেলার নামই প্রকৃত কুরবানি। এটি আত্মশুদ্ধির এক আধ্যাত্মিক উপলক্ষ, যেখানে প্রতিটি ছুরি চলে না কেবল পশুর গলায়, বরং চলে অন্তরের তমসা বিদীর্ণ করতে।

ঈদুল আযহা আমাদের শিখিয়ে দেয় মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের গুরুত্ব। যারা কুরবানি দিতে পারেন না, তাদের জন্য নিজের অংশ ভাগ করে দেওয়া, গরিব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটানো—এই সামাজিক দায়বদ্ধতা ঈদুল আযহাকে শুধুই ব্যক্তিগত উৎসব নয়, বরং মানবিকতার এক সমবেত উৎসবে পরিণত করে। এদিন ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে সমান আনন্দ, সমান প্রাপ্তির অনুভূতি।

গরুর চামড়ার গন্ধ, নতুন কাপড়ের খুশবু, রান্নাঘর থেকে আসা মাংসের সুগন্ধ, বাচ্চাদের চিৎকার, কোলাকুলির দৃশ্য—এসব সব মিলে যেন একটি জীবনমুখী চিত্রকল্প গড়ে তোলে। ঈদ মানে আনন্দ, কিন্তু এই আনন্দের শিকড় গেঁথে আছে আত্মত্যাগের গাঢ় মাটিতে।

আজকের আধুনিক সমাজে, যেখানে ভোগবিলাস, প্রতিযোগিতা আর আত্মমর্যাদার নামে অগণিত ‘আমি’ প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলে, সেখানে ঈদুল আযহার আত্মত্যাগের শিক্ষা এক নবজাগরণের সূচনা করতে পারে।

কুরবানির পশু আজ অনেকের কাছে হয়ে উঠেছে কেবল বাহারি প্রতিযোগিতার একটি প্রতীক। অথচ উৎসবটির অন্তরকথা বলছে—নমনীয়তার, উদারতার, এবং সবকিছুর ওপরে আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা।

ঈদুল আযহা আমাদের শেখায়—যে জীবন নিজের চেয়ে বড় কোনও আদর্শের জন্য উৎসর্গ করা যায়, সেই জীবনই প্রকৃত জীবন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কাহিনি যেন সময়ের সীমানা পেরিয়ে আজও বলে—”ত্যাগেই প্রকৃত প্রেম, আত্মসমর্পণেই রয়েছে পরিপূর্ণতা”।

আর সেই প্রেম ও আত্মসমর্পণের মহোৎসবই ঈদুল আযহা—যেখানে প্রতিটি মুসলমান একযোগে উচ্চারণ করে, “আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু—সবকিছুই আল্লাহর জন্য।”

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মোস্তফা
কুমিল্লা
আরও পড়ুন