ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫

মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

‘জীবনের রঙিন ক্যানভাস’

'Colorful Canvas of Life'
লেখক/ছবি পোস্টার এআই জেনারেটেড/গ্রাফিক্স: রাইজিং কুমিল্লা

নতুন কলেজের প্রথম দিন আজ। তাই বেশ উৎসাহ নিয়ে কলেজে গেলাম। ফেরার পথে একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখলাম ,যে কলম বিক্রি করছিল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে কলম নিতে বলছিল, কিছুটা কাঁদো কাঁদো গলায়। আমার মায়া হওয়ায় পাঁচটি কলম কিনলাম এবং বাড়িতে ফিরে এলাম। আমার একটা অভ্যাস ছিল প্রতিদিন মাঠে ক্রিকেট খেলা।

আজ দুপুরে যাওয়ার সময়‌ সেই কলেজের সামনে দেখা ছোট্ট মেয়েটি। তাকে দেখে বললাম তুমি এখানে কি করছ। সে বলল আমি এসময় ফুল বিক্রি করি। আমি বললাম কিছু খেয়েছো। সে নরম গলায় জবাব দিল এখনো কিছু খাইনি, তখন ঢের বিকেল হয়েছে বলতে পারেন, পড়ন্ত বিকেল বেলা।

সেই দুপুর একটাই খাবার খাওয়া একটি ছোট্ট মেয়ে ফুল বিক্রি করছে কোন কিছু না খেয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিছু খাবে? সে লজ্জায় তার চোখ নামিয়ে ফেলল। বুঝতে পেরে আমি বললাম চলো তবে দোকানের দিকে।

তাই তাকে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে গেলাম সেখানে গিয়ে তাকে বন পাউরুটি ও চা খাওয়ালাম। সঙ্গে তার সাথে বসে কতক্ষণ গল্প করলাম এবং জানতে পারি সে প্রথমের দিকে ভিক্ষা করতো কিন্তু একসময় একটি মানুষ খুব শিক্ষিত ছিল (ছোট বাচ্চাটির ভাষ্যমতে) সে বলেছিল তুমি কেন ভিক্ষা করো।

সে জবাব দিল ছোটবেলায় তার বাবা মারা যায় এবং সে তার মায়ের অভাবের সংসারে বড় হয়েছে অর্থাৎ তার বয়স এখনো বেশি নয় ১০ বছর মাত্র।

আমি মনে মনে ভাবছি (কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে জীবনের বাস্তবতা )। হঠাৎ সে বলে উঠলো:-তাই পেটে কিছু খাবার জোগাতে অন্তত নাস্তা, খাবারের অল্প টাকা জোগাড় করতে সে সকালে কলম বিক্রি করে এবং দুপুরে খেলার মাঠে ফুল বিক্রি করে। কারণ মাঠের পাশে একটি পার্ক রয়েছে যেখানে অনেক কপুত কপুতিরা আগমন করে তাই তার ফুল বিক্রি মোটামুটি বলা চলে ভালই হয়।

তো আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোমার সংসারে তো বললা, মা আছেন শুধু তবে তোমাকে এই ব্যবসার জন্য পুজিটি কে ধরে দিল? সে প্রতি উত্তরে বলল ওই যে বললাম একজন শিক্ষিত মানুষের কথা তিনি আমার এই অবস্থা দেখে আমাকে অল্প কিছু টাকা দিয়ে প্রথমে কলম কিনে দেন আর যে অল্প টাকাটা ছিল।

তারপর পরবর্তীতে আমি দু-একটা ফুল কিনে বিক্রি করেছিলাম,দেখলাম এতে অনেক লাভ রয়েছে কারণ পার্কে প্রেমিকেরা প্রায়শই ফুল কিনে। তাই আমি ফুলের ব্যবসার দিকে এগোলাম এখন কিছুটা ভালো আছি এই ব্যবসা করার কারণে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম এই ছোট্ট মেয়েটির কতইনা বুদ্ধি কতই না বাস্তবতা বুঝার জ্ঞান তো আমি আরো জিজ্ঞাসা করলাম তোমার এই অল্প বয়সে তুমি স্কুলে না গিয়ে এই ব্যবসা করছ!!! তোমার কি ভালো লাগছে সে প্রতি উত্তরে বলল আমারও অন্যান্য মেয়েদের মত বিদ্যালয়ে যেতে ইচ্ছা করে, তবে আমার মায়ের ওই অবস্থায় আমাকে বিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে না ।

তাই আমিও মেনে নিয়েছি আমার এই বাস্তবতাকে। তবে আমার ইচ্ছা আছে যদি স্কুলে পড়তে পারি নিশ্চয়ই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল হব। যাতে করে মাকে সুখে রাখতে পারি। বাহ তোমার ইচ্ছা তো বেশ ভালই। তবে এই পেশা নিয়ে তুমি জানতে পারলে কিভাবে কে তোমাকে বলেছে এসব বিষয়। সে বলল আমি অনেক জায়গায় কলম বিক্রি করি, আবার অনেক জায়গায় ফুল বিক্রি করি ওইখানে মানুষকে শুনেছি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বলতে, আবার উনাদের ওষুধের কথা বলতে।

আরো শুনেছি একটা বিল্ডিং করতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কত টাকা মাইনে পান। আবার শুনেছি উকিল সাহেবরা কোর্টে লড়াই করেন, তার জন্য নাকি তারা আবার টাকাও পান তাই আমি চিন্তা করলাম যে বড় হয়ে এসব করব যাতে করে টাকা রোজগার করে মাকে একটি ভালো জীবন দিতে পারি এটাই আমার স্বপ্ন।

চা প্রায় শেষের দিকে তো আমি বললাম তোমাকে যদি আমি মানুষ থেকে সাহায্য নিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাই তুমি কি পড়বে? সে প্রতি উত্তরা বলল হ্যাঁ অবশ্যই। যদি এমনটা হতো কতই না ভালো হতো । তো আমি বললাম তুমি একটু অপেক্ষা করো একটি কাগজের টুকরে আমার নাম্বারটা দিলাম এবং বললাম আমাকে ১০ দিন ১৫ দিন পরে মানুষ থেকে মোবাইল নিয়ে একটা কল দিও।

তো যেমন কথা তেমন কাজ আমার বাবা থেকে কিছু টাকা নিলাম এবং বন্ধু-বান্ধবরা মিলে কিছু টাকা জমা দিলাম। এভাবে করে হাজার দশেক টাকা জমা হল, এইবার মাত্র সময় লাগলো দু’দিন তাই আমি ওর কলের অপেক্ষা না করে সরাসরি তার ফুল বিক্রির স্থানে চলে গেলাম এবং তাকে খুঁজে বের করলাম এবং তাকে বললাম কাল সকালে একটি স্কুলের সামনে যেতে এবং আমিও সময়টি নির্ধারণ করে দিলাম সে আসলো এবং তাকে নিয়ে বিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষ করে তাকে ক্লাস ফোরে ভর্তি করালাম। কারণ সে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল বাবা চলে যাওয়ার পরে দুই বছর পড়ালেখা করেনি তাই আবার চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করালাম। আস্তে আস্তে যতটুক পারা যায় তার পড়ালেখার সাহায্য করলাম।

সে পঞ্চম শ্রেণীতে বোর্ড পরীক্ষাতে বৃত্তি পেল এরপর থেকে সে সরকারি অনুদান পায়। তার আর ফিরে তাকাতে হয়নি পিছনে এখন শুধু তার হাতের সফলতা ধরা দিচ্ছে একে একে সে অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পায় এবং দশম শ্রেণীতেও পায়। কিন্তু আমি সব সময় তার খোঁজ খবর নিতাম সে দশম শ্রেণীর পাশ করার পর আমার কাছে আসলো কোন কলেজে ভর্তি হবে ওই সময় কিছুটা টাকার অভাব দেখা দিয়েছিল তার ফ্যামিলিতে।

তাই আমি আবার সাহায্য করলাম। আমি একটি চাকুরীতে নিযুক্ত ছিলাম। তাই তাকে সাহায্য করতে আমার কোন কষ্ট হয়নি এবার কারো থেকে টাকা নিতে হয়নি এবং তাকে একটি এলাকার স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি করালাম।

কারণ তার জিপিএ অনেক ভালো ছিল। ভর্তি করাতে কোন সমস্যা হয়নি এবং পুরা দু’বছর তাকে পড়ালেখার পরামর্শ পড়ালেখার খরচ সব বহন করলাম এবং তাকে উচ্চমাধ্যমিক এর প্রথম বর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতি ও মেডিকেলের প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করছিলাম এবং দেখতে দেখতে তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলে আসলো এবং সে পরীক্ষা খুব ভালো দিয়েছিল এডমিশনের সময় আর বেশিদিন নেই তারই মধ্যে তার উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হলো এবং আমি ল্যাপটপে তার রেজাল্ট দেখার জন্য বসে আছি এবং পাশে এসে বসে আছে সে। খুব ভয়ে ভয়ে তার রোল নাম্বারটি দিল এবং আমি রেজাল্ট দেখছিলাম আমার আত্মবিশ্বাস ছিল সে খুব ভালো রেজাল্ট করবে ,দেখতে দেখতে রেজাল্ট আসলো এবং দেখলাম সে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছে। সবগুলোতে অনেক ভালো নাম্বার পেয়েছে।

কিছুদিন পরে সে বোর্ড থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে। এরপর যখন মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দিল আমার তখনও আত্মবিশ্বাস ছিল এবং সে মেডিকেলে টিকবে। যখন তার পড়ালেখা শেষ হলো সে বিসিএস স্বাস্থ্যে টিকলো। সে আমার কাছে আসলো সে বলল আপনি আমার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলা চলে আমার বড় ভাই বা বাবার মত আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আমি সেই ছোট্টবেলায় ভিক্ষা করতাম, আমাকে সে ভিক্ষা থেকে সরিয়ে অল্প টাকা দিয়ে একটি ছোট্ট ব্যবসা ধরিয়ে দেয় তখন আমি একটি জিনিস বুঝতে পারলাম শিক্ষিত মানুষ আসলেই শিক্ষিত।

তিনি ব্যবসাটাকে আমার জন্য নির্বাচন করলেন কারণ ভিক্ষা থেকে ব্যবসা উত্তম যদিও বা তার ছোট হয় কিন্তু তিনি যদি আমাকে ওই ব্যবসাটা ধরিয়ে না দিয়ে যদি বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতেন তবে মনে হয় আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। হয়তোবা তিনি ওই পর্যন্ত ভাবেননি তাই আমাকে ছোট ব্যবসাটি ধরে দিলেন যাতে আমি নিজের খাবারের অল্প ব্যবস্থা করতে পারি।

কিন্তু আপনি আমার জীবনকে ঠিক ওইভাবে দেখেছেন যেভাবে একজন শিক্ষিত মানুষ সত্যিকার অর্থে দেখে, যার লোভ থাকে পড়ার প্রতি। আপনি আমাকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন এবং আশাবাদী করেছেন আপনার সহায়তায় আমি মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম এবং আপনার ইন্সপিরেশনে আমি আজ মেডিকেলে টিকলাম এবং মেডিকেল পাস করে বিসিএস স্বাস্থ্যে টিকলাম। আজ পরিপূর্ণ ডাক্তার এর পিছনে একজন মানুষের হাত যার অবদান কখনো ভুলার নয় সেটাই আপনি।

তার চোখে অশ্রুজল দেখে আমি বললাম একসময় আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার কিন্তু আমি হতে পারিনি ।তোমার মধ্যে পড়ার সেই স্পৃহা দেখলাম যা আমাকে সব সময় তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মনে করিয়ে দিত ।পরিশ্রম তোমার ,পাশে থাকতে পেরে আমি আনন্দিত ।বোন আমার, তোমার এই সফলতা আমাকে গর্বিত করেছে তবে একটি কথা মনে রাখবে তোমাকে এ পর্যায়ে আসতে, নগণ্য সাহায্য করেছি তাতে আমি খুশি।

তবে আমি চাই তোমার সামনে যদি এমন কোন পথশিশু পরে, যার টাকার অভাব, সে ছোট কাজ করছে বিদ্যালয়ে যাবার বদলে। তুমি নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করবে। সমাজে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবে যাতে করে পথ শিশুদের আর কোনভাবে হেনস্তার স্বীকার হতে না হয়।

যাতে তারাও একটি সুন্দর জীবন পায়। তাদেরও সুন্দর জীবন পাবার অধিকার আছে। আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো উচিত চলুন এগিয়ে যাই সমাজের অন্যান্য ধনী গরিব সকলকে নিয়ে এবং উন্নত হোক আমাদের দেশ।

মোঃ মারুফুর রহমান

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। কবি,গল্পকার ও সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।