বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। গুণী লেখক অনেকেই, তবে কালজয়ী লেখক তারাই, যাদের লেখায় একইসাথে সমসাময়িক যুগের ও যুগোত্তরের প্রতিরূপ মূর্তি স্থাপনা হয়। প্রয়াত আহমদ ছফা ঠিক সে রকম একজন লেখক। তার সময়ের লেখার যা বাস্তবতা, এক যুগ পরও আজকের সমাজের সেই একই মৌলিক পরিস্থিতি, খুব একটা ভিন্নতা নেই সেখানে।
“গাভী বিত্তান্ত” ঠিক তেমনই একটি উপন্যাস, প্রকাশভঙ্গিও নতুন। আমাদের চোখের সামনে অনেক কিছু ঘটে যা আমরা অকপটে বলতে বা লিখতে পারি না। সমাজে বিষয়গুলোকে বলা হয় ‘ওপেন সিক্রেট’। আমাদের সাহিত্যেও
এ ধরনের বিষয় কদাচিৎ আসে। শুধুমাত্র গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকলেই এ ধরনের বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায়। আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসটি তেমনই এক বিষয়ের ওপর লেখা, যা নিয়ে সচরাচর সাহিত্য হয় না।
“গাভী বিত্তান্ত” আমার পড়া আহমদ ছফার প্রথম বই যা পড়ার পর আমি উনার চরম ভক্ত হয়ে উঠি। তার লেখার ভাষাশৈলি, প্রকাশভঙ্গি, চিত্রনাট্য যেন বাস্তবিকতাকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলে। যে লেখা বিংশশতাব্দীতে প্রকাশ পায় তার গ্রহণযোগ্যতা এবং আবেদন একবিংশ শতাব্দীতেও সমান থেকে যাওয়ার মধ্যে আহমদ ছফার সেন্স অব হিউমার অনুভব করা যায়। উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু একটি স্বনামধন্য প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মূল চরিত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত উপাচার্য মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আবু জুনায়েদের আরোহনের পূবর্বর্তী এবং পরবর্তী ঘটনাচক্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। আবু জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি হলেও নিজের ঘরে বেগম নুরুন্নাহার বানুর কাছে তিনি বড় অসহায়।
শ্বশুরের টাকায় আবু জুনায়েদ লেখাপড়া করেছেন, এই খোটা নুরুন্নাহার বানু উঠতে বসতে তাঁকে দেন। আবু জুনায়েদ রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক।নিতান্ত গোবেচারা এবং সহজ-সরল মানুষ। এই মানুষটিকে উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনে নিয়ে আসেন তাঁর ডিপার্টমেন্টের অনুজ শিক্ষক দিলরুবা খানম। পূবর্বর্তী উপাচার্যের প্রতি ক্ষোভ থেকেই তিনি শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ডোরাকাটা দলের হয়ে উপাচার্য প্যানেল ঘোষণা করেন। এই প্যানেলের তিন শিক্ষকের মধ্যে ভাগ্যক্রমে আবু জুনায়েদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হোন। আবু জুনাইদ সপরিবারে উপাচার্য ভবনে বাস করতে থাকেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ায় নিজের আভিজাত্য এবং পদের গাম্ভীর্য প্রকাশ করতে আবু জুনাইদ সকল জায়গায় নিজেকে প্রেজেন্টেবল রাখতে থাকেন। এ যেন— “শির দিয়ে বাঁকা তাজ ঢেকে রাখে টাক।”
এদিকে আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেগম। তার খুশি আর মনে ধরে না, ফেটে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। যার পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন নুরুন্নাহার বানুর বাবা, যার কোনোদিকে কোনো খেয়াল থাকতো না, সমাজে এমনকি ঘরের চার দেয়ালের মাঝেও তেমন দরাজ ছিল না যার, সেই আবু জুনায়েদ হঠাৎ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বনে যান, তার স্ত্রী তখন ভাবেন, এ তো সতীর ভাগ্যে পতির জয়। তাছাড়া আর কী! এর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য ছিলেন, তার উপরে অন্যান্য দলীয়ভুক্ত শিক্ষকেরা ছিলেন ক্ষ্যাপা, ক্ষুব্ধ।
তাই সাদা-কালো ডোরাকাটা দলপন্থী শিক্ষকরা তার ঐ পদে বহাল থাকাটা মেনে নিতে পারছিলো না। সব প্রবীণ শিক্ষকই সুযোগ খুঁজছিলেন কখন এই উপাচার্যের দোষ ত্রুটি তুলে ধরে আন্দোলন, বিদ্রোহ তৈরি করে তাকে সরিয়ে নিজেরা আসনে বসবেন। সেসব কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি ছিলেন এক সুন্দরী অবিবাহিতা শিক্ষিকা, দিলরুবা খানম। তারই জেরে আবু জুনায়েদ উপাচার্যের আসনে উন্নীত হয়ে যান, আর অন্যান্য প্রবীণেরা ভেতরে ভেতরে আবু জুনায়েদের প্রতি ক্ষোভের পাহাড় জমানো আরম্ভ করেন। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকার ফলে আবু জুনাইদ উপাচার্য পদে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নোংরা রাজনীতির রোষানলে পড়ে।
এক্ষেত্রে একদলের দাবি পূরণ বা স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে অন্যদলের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। এখানে দেখা যায় হোস্টেলের ডালে পানি বেশি হলে ভিসির বাসভবন ভাঙচুর করা হয়। ছোটখাটো থেকে শুরু করে সকল কাজের দায়ভার গিয়ে পড়ে আবু জুনাইদের উপর। পরিবারে যেকোনো ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর অশান্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দুর্বলতার সুযোগে দিন দিন রাজনীতি-খুন বেড়ে যাওয়া, সময়ের আগেই তহবিলের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া- এ নিয়ে আবু জুনায়েদের চিন্তার শেষ ছিল না। গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম আবু জুনায়েদের। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একটা গাভী পালন করবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করে তার এক ঠিকাদার চাচা শশুর যার হাত ছিল মন্ত্রী মিনিস্টার থেকে শুরু করে বড় বড় পদের মানুষদের পর্যন্ত।
ঠিকাদার শেখ তবারক আলী উপাচার্যকে হাতে রাখতে জুনায়েদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে একটি দুর্লভজাতের লাল রংয়ের অপূর্ব সুন্দর গাভী কিনে দেন, ছিপ নৌকার মতো লম্বা শরীরের গরুটির নাম ছিল তরণী। ভিসির বাংলোতে তবারক আলী নিজ জামাতা বুয়েটপাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবেদ হোসেনকে দিয়ে গোয়ালঘর বানিয়ে দেন। পরবর্তীতে উপাচার্য আবু জুনায়েদের জীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সবটাই হয়ে পড়ে গোয়ালঘরকেন্দ্রিক। শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সভা, আড্ডা সবই তিনি করতেন গোয়ালঘরে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং ফাইলে সই করতেন গোয়ালঘরে বসেই। আহমদ ছফা লিখেছেন “মোগল সম্রাটরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার হলেও গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন।” আবু জুনাইদ গোয়ালঘরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, সাংসারিক কলহ থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মনে করতেন। যেখানে একটা নিষ্পাপ প্রাণীর কাছাকাছি সে থাকতে পারে যার মধ্যে কোনো দাবি নেই, কলহ নেই। যার চোখ ছিল আকর্ষণীয়। এই গোয়ালঘর এবং তরণী আবু জুনাইদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা বনলেও তার স্ত্রীর কাছে তা প্রধান শত্রুর উৎস। স্বামীর উপেক্ষা এবং নিস্পৃহতার দরুণ নুরুন্নাহার বানু তরণীকে নিজের সতীন ভাবতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে গাভীটিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন।
পেশাগত কাজে স্বামী বাইরে গেলে তরণীর খাদ্যে বিষ মেশান নুরুন্নাহার বানু। বাসায় ফিরে তরণীকে অসুস্থ দেখেন আবু জুনায়েদ। ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে আসা বক্তৃতার অফারের কথা স্ত্রীকে জানাতে গেলে নুরুন্নাহার বানু জানান তিনিই গাভীটাকে হত্যা করেছেন। গাভী ও গোয়ালঘরের কাহিনীর অবতারণা করে লেখক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ দৈন্য দশা ও ছাত্র-শিক্ষক নোংরা রাজনীতির দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা ‘সারকাজম’ মনে হলেও এতে রয়েছে তীক্ষ্ম ভাব। দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখলে এখানে কয়েকটি পার্সপেক্টিভ ফুটে উঠে। প্রথমত, সম্ভ্রান্ত এবং সনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ পদে অযোগ্য ব্যক্তিরা কীভাবে স্থান পায় তা বাহ্যত জবাবদিহিতা নেই। একটা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদসমূহে অযোগ্য লোক বসলে সেই প্রতিষ্ঠানের দৈন্য দশা এবং ভঙ্গুর অবস্থা এখানে লক্ষণীয়। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির অপসংস্কৃতি যার ফলে একজন ঠিকাদারের হাত কীভাবে মন্ত্রী মিনিস্টার পর্যন্ত যেতে পারে তা আমরা এখানে দেখতে পাই। শিক্ষকদের মধ্যে নোংরা রাজনীতি যদি হয় মূখ্য তখন জাতি গড়ার মূল মন্ত্র হয়ে যায় গৌণ।
তৃতীয়ত, কোনো লোক ক্ষমতায় আসলে তার মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আসে এবং তা চারপাশের পরিবেশ কীভাবে গ্রহণ করছে তা এখানে প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
এই উপন্যাসে ফ্যান্টাসি এবং নিখাদ বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যা শৈল্পিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে। বেদনা এবং মমত্তবোধের কারণে উপন্যাসটি কোথাও কোথাও সমুদ্রের গভীরতা অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্পণে দেশ সমাজ এবং জাতিকে নিরীক্ষণের মহামূল্য প্রমাণ হিসেবেও রচনাটির গুরুত্ব সকলের মনোযোগের দাবি রাখে।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।