শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় গ্রামীণ বাংলার রান্নাঘরে খেজুরের রসের স্বাদে মিশে যায় নানা রকম পিঠা, পায়েস। এই মৌসুমে গাছিরা দিন-রাত এক করে ব্যস্ত থাকেন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা গাছের মাথা পরিষ্কার করে মাটির কলসি বেঁধে রাখা হয়। সকালে সেই কলসি থেকে সংগ্রহ করা হয় মিষ্টি রস। এই রস থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি ও লালি গুড়।
চলুন জেনে নেওয়া যাক-
কেন শীতকালেই খেজুর গাছ রস দেয়?
খেজুর গাছ মূল দিয়ে পানি শোষণ করে, যা পাতায় পৌঁছে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। পরে এই গ্লুকোজ সুক্রোজে পরিণত হয়, যা গাছের প্রয়োজন মেটানোর পর স্টার্চ হিসেবে জমা থাকে। শীতকালে মাটিতে পানির অভাব দেখা দেয়। ফলে গাছ তার প্রস্বেদন কমিয়ে খাদ্য মজুত রাখতে শুরু করে। শীতের কম তাপমাত্রা গাছকে সংকেত দেয়, যার ফলে এক ধরনের এনজাইম তৈরি হয়। এই এনজাইম স্টার্চ ভেঙে চিনিতে পরিণত করে। মূল থেকে উঠে আসা পানির সঙ্গে এই চিনি মিশে মিষ্টি রস তৈরি করে। শীতকালে গাছের ক্ষতস্থান দিয়ে এই রস সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। আর এই রসের পরিমাণ অনেক বেশি হয়।
তাই বলে কি গরমকালে খেজুর গাছের রস পাওয়া যাবে না?
পাওয়া যাবে। কিন্তু তা পরিমাণে খুব কম। তাহলে গরমেও তো কিছুটা রস গাছিরা সংগ্রহ করে গুড় বানাতে পারেন।
গরমকালে ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকে খুব বেশি। খাওয়া কিংবা গুড় তৈরির উপযোগী রস পেতে হলে ২০ ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রা থাকতে হয়ে। তাপমাত্রা এর বেশি হলেই সহজেই রসে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে এবং নষ্ট হয়ে যায়। সেই রস পানের অযোগ্য হয়ে যায়। এমনকি গুড়ও হয় না সেই রসে।
এ কারণেই গাছিরা সন্ধ্যায় গাছ কাটেন। সারা রাত নলি বেয়ে রস জমা হয় মাটির ভাঁড়ে। সকালে ঠাণ্ডা থাকতে থাকতে রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে ফেলা হয়।
এছাড়া শীতকালে রস যদি দুপুর পর্যন্ত রাখা হয়, সেই রস আর খাওয়া যায় না। সেই রস থেকে ভালো গুড়ও পাওয়া যায় না। শীতের সময় বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে। ফলে রস সহজে নষ্ট হয় না। এই শুষ্ক পরিবেশ খেজুরের রসের সতেজতা বজায় রাখে এবং এটি দীর্ঘক্ষণ তাজা থাকে।
গরমের সময় বিভিন্ন পোকামাকড়, যেমন মাছি বা পিঁপড়া, খেজুরের রসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু শীতে এসব পোকামাকড় তেমন সক্রিয় থাকে না, তাই রস সংগ্রহ করা সহজ হয়।
খেজুর গাছের রস উৎপাদনের প্রক্রিয়া:
শীতকালে গাছের প্রস্বেদন কম হওয়ায় পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে বের হয় না। ফলে গাছের ভেতর সঞ্চিত চিনিযুক্ত রস ক্ষতস্থান দিয়ে বের হয়। যত বেশি রস সংগ্রহ করা হয়, গাছের অভ্যন্তরে ব্যাপন চাপ কমে যায়, যা মাটি থেকে আরও পানি শোষণে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে পুরো শীতকাল জুড়ে।
খেজুর গাছের বয়স ও রস উৎপাদন:
একটি খেজুর গাছ রস উৎপাদনের জন্য কমপক্ষে পাঁচ বছর বয়সী হতে হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ শীতের মৌসুমে প্রায় ১৫০ থেকে ১৬০ লিটার রস উৎপাদন করতে সক্ষম। তবে গাছের গোড়ায় ছিদ্র করলে রস সংগ্রহ সম্ভব নয়।
মনে রাখতে হবে, খেজুরের রস শুধু শীতকালীন এক বিশেষ উপহার নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের সকালে খেজুরের রসের স্বাদ নিতে হলে গাছিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা মনে রাখা উচিত।